মাঠের খেলায় অবশ্য তেমন প্রতিফলন দেখাতে পারেননি নাজমুল হোসেন শান্তরা। চেন্নাই টেস্টে মাত্র সাড়ে তিন দিনের মাথায় রেকর্ড ২৮০ রানে হারের পর কানপুরে বৃষ্টিবিঘ্নিত শেষ টেস্টেও আড়াই দিনে হার। এবার ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছে। অথচ বৃষ্টির কারণে বলতে গেলে দুই দিনের বেশি খেলা হয়নি। ম্যাচে সব মিলিয়ে খেলা হয়েছে মোট ১৭৩.২ ওভার। এমন টেস্টও বাঁচাতে পারেনি বাংলাদেশ।
চলতি বছরের শুরুতে কেপটাউনে দেড় দিনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে টেস্টে হারিয়েছিল ভারত। এবার বাংলাদেশকে দুই দিনে হারাল সেই একই দল। প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ হলেও এই জয়টা ভারতের জন্য বিশেষই হয়ে থাকবে। ম্যাচশেষে এমনটাই জানিয়েছেন ভারতীয় তারকা পেসার জসপ্রীত বুমরাহ। দারুণ বোলিং-ব্যাটিং আর আগ্রাসী পরিকল্পনায় ভারত আরও একবার প্রমাণ করল কেন তারা টেস্টের ‘নাম্বার ওয়ান’।
সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনি যেমনটা বলছিলেন, চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় সেশনে প্রথম ইনিংসে ব্যাটিং শুরু করছে যে দল, সেই দল যে জয়ের কথা ভাবতে পারে, সেই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টায় সফল হয় দারুণভাবে… এটা অনন্য এক নজির…। ভারতের টেস্ট দলকে যেমন এটা এক ধাপ এগিয়ে নেবে, সামগ্রিক টেস্ট ক্রিকেটকেও পরের ধাপে নিয়ে যাবে ভারতের এই জয়। ম্যাচ শেষে জাসপ্রিত বুমরাহ বললেন, ‘স্পেশাল এক জয়…।’ অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখনো ক্রিকেটের বনেদি সংস্করণ টেস্ট দ্বৈরথে কতটা পিছিয়ে সেটাই যেন দেখাল কানপুর টেস্ট।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালের রেসে টিকে থাকতে ঘরের মাটিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে এই টেস্টে জয়টা গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারতের জন্য। যে কারণে গতকাল (সোমবার) চতুর্থ দিনের লাঞ্চব্রেকেই জেতার ছক কষেছিলেন রোহিত শর্মারা। যেমন পরিকল্পনা, তেমন কাজ। বাংলাদেশকে ২৩৩ রানে থামিয়ে দেওয়ার পর টি-টোয়েন্টি মেজাজে ব্যাটিংয়ে মাত্র ৩৫ ওভারেই প্রতিপক্ষের রান টপকে ৫২ রানের লিড নিয়ে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেয় ভারত।
স্বাগতিক ব্যাটারদের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পর বাকি কাজটা অনায়াসেই সারেন ভারতীয় বোলাররা। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশকে মাত্র ১৪৬ রানে আটকে ফেলেন বুমরাহ-আকাশ দীপরা। ফল অমিমাংসিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকা টেস্টে ভারতের জয়ের জন্য লক্ষ্যটা দাঁড়ায় মাত্র ৯৫ রান। হাতে তখনো দুই সেশনের খেলা বাকি। রান তাড়ায় নেমে তিন উইকেটের পতন হলেও জয় পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি স্বাগতিক ভারতের। ৭ উইকেটের জয়ে দুই ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করেছে টিম ইন্ডিয়া।
ম্যাচ শেষে নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে ভারত অধিনায়ক জানান, ‘আমরা ভাবছিলাম খেলাটা কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়। আড়াই দিনের বেশি বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে গেলে চতুর্থ দিনে চেয়েছি ওদের দ্রুত গুটিয়ে দিতে। লাঞ্চের পর যখন ২৩৩ রানে ওদের আটকে দেই আমরা চেয়েছি দ্বিতীয় ইনিংসে ওদের অলআউট করার জন্য পর্যাপ্ত ওভার রাখা।’
বাংলাদেশ কোথায় পিছিয়ে গেল?
চতুর্থ দিনে লাঞ্চ ব্রেকের পর ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও যশস্বী জয়সওয়ালের দ্রুত রান তোলার মনোভাব দেখেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল ম্যাচের ফলের জন্যই খেলছে ভারত। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েছিল ভারত। কিন্তু দ্রুত বাংলাদেশের রান শোধ করে কিছুটা লিড নেওয়ার পরিকল্পনায় ছিল। বাংলাদেশের বোলারদের ওপর রীতিমতো স্টিমরোলার চালিয়ে ব্যাটারদের সাফল্যের পর শেষ বিকেলে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে টাইগারদের দ্রুত দুই উইকেটের পতন তাদের পরিকল্পনা আরও এগিয়ে দেয়।
টেস্ট বাঁচাতে পঞ্চম দিনে বড় জুটি দরকার ছিল বাংলাদেশের। আর তাতে লিডটাও ভারতের ধরাছোঁয়ার বাইরে যেতে পারতো। যেমনটা আগের দিনই প্রেস কনফারেন্সে জানিয়ে ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, ‘টেস্ট ক্রিকেটে কিন্তু সবই সম্ভব। আমরা যে হেরে গিয়েছি তেমন কিন্তু নয়। আমাদের জন্য একটা সুযোগ আছে। উইকেটটা ভালো আছে। আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা যদি ওপর (টপ অর্ডার) থেকে ভালো একটি জুটি গড়তে পারি, একটি সেশন যদি ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট করতে পারি, অবশ্যই আমাদের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে।’
তবে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিংয়ের কাজটা কেউ করেনি আদতে। চতুর্থ উইকেটে শান্ত-সাদমানের ৫৫ রানের জুটিটা কিছুটা আশা দেখালেও টাইগার অধিনায়কের রিভার্স সুইপে আত্মহুতির পরই যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং অর্ডার। ৯১ রানে ২ উইকেট থেকে বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ৯৪ রানে ৭ উইকেট! মাঝে ৩ রান তুলতেই নেই ৫ উইকেট। শেষমেশ ১৪৬ রানেই থামতে হয়।
কানপুরের গ্রিন পার্কে এর আগে চতুর্থ ইনিংসে ৮২ রানের বেশি করে জিততে পারেনি কোনো দল। আজ অবশ্য ভারতকে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ১৭ দশমিক ২ ওভারেই ৩ উইকেট হারিয়ে জয় নিশ্চিত করে স্বাগতিক দল। চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় সেশনে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামা দলটা যখন জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে, দিনের গোটা একটি সেশন তখনো বাকি। এমন জয়কে বিশেষ না বলে উপায় আছে!
এদিকে বাংলাদেশের এমন ভরাডুবির পর একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করার পর পুরস্কার দেওয়া ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা এখন ফেরত নেওয়া হোক। সঙ্গে দুইদিনে ম্যাচ হারার জন্য আরো ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হোক। জরিমানা হোক বা না হোক অন্তত সিরিজটি নিয়ে পর্যালোচনা হোক। আসন্ন ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের আগেই সেটি হোক।