দারুণ পারফরম্যান্সে লিড নেওয়ার পর খেই হারিয়ে ফেলল স্পেন। প্রতিপক্ষের ওপর প্রবল চাপ বাড়ালেও গোলের দেখা পাচ্ছিল না জার্মানি। বিদায়ের দুয়ারে গিয়ে গোল করে ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে টেনে নিল তারা। সেখানে শেষ সময়ে গোল করে জার্মানদের স্তব্ধ করে দিলেন মিকেল মেরিনো। টানা পঞ্চম জয়ে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠল স্প্যানিশরা।
স্টুটগার্টে গত শুক্রবার (০৫ জুলাই) প্রথম কোয়ার্টার-ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতেছে স্পেন। রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, বিতর্ক ও নাটকীয়তায় ঠাসা লড়াইয়ে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে দানি ওলমো স্পেনকে এগিয়ে নেওয়ার পর ৮৯তম মিনিটে ফ্লোরিয়ান ভিরৎজের গোলে সমতায় ফেরে জার্মানি। ১১৯তম মিনিটে ব্যবধান গড়ে দেওয়া গোলটি করেন মেরিনো। গোলদাতা তিন খেলোয়াড়ই মাঠে নেমেছিলেন বদলি হিসেবে!পুরো ম্যাচে ৪৮ শতাংশ সময় পজেশন রেখে গোলের জন্য মোট ১৮টি শট নেয় স্পেন, যার ৬টি লক্ষ্যে ছিল। প্রথমার্ধে গোলের জন্য মাত্র তিনটি শট নেওয়া জার্মানি বাকি সময়ে শট নেয় আরও ২০টি, লক্ষ্যে থাকে সব মিলিয়ে ৫টি।
আগের কয়েক ম্যাচের ধারাবাহিকতায় জার্মানির বিপক্ষেও শুরুতে ছড়ি ঘোরায় স্পেন। প্রথম মিনিটেই আক্রমণে ওঠে তারা। নিকো উইলিয়ামসের পাস খুঁজে পায় আলভারো মোরাতাকে। এই ফরোয়ার্ডের পাসে পেদ্রির শট ঠেকান গোলরক্ষক মানুয়েল নয়ার। মাঠে নেমেই একটি রেকর্ড গড়েন নয়ার। বাস্টিয়ান শোয়াইনস্টাইগারকে (৩৮) ছাড়িয়ে বড় টুর্নামেন্টে (বিশ্বকাপ, ইউরো) জার্মানির হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড এখন বায়ার্ন মিউনিখ গোলরক্ষকের (৩৯)।
অষ্টম মিনিটে বড় এক ধাক্কা খায় স্পেন। জার্মান মিডফিল্ডার টনি ক্রুসের ট্যাকলে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মিডফিল্ডার পেদ্রি। তার বদলি নামেন দানি ওলমো। ইউরোর ইতিহাসে দ্রুততম বদলির ঘটনা এটিই। স্পেনের আক্রমণের ধার অবশ্য কমেনি। দ্বাদশ মিনিটে দূর থেকে চেষ্টা করেন উইলিয়ামস। এই তরুণের শট লক্ষ্যে থাকেনি। পঞ্চদশ মিনিটে আরেক তরুণ লামিনে ইয়ামালের নিচু শটও হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট।
২১তম মিনিটে প্রথমবার স্পেন গোলরক্ষকের পরীক্ষা নিতে পারে জার্মানি। যদিও কাই হাভার্টজের হেড ঠেকাতে খুব একটা সমস্যা হয়নি উনাই সিমনের। ৩৪তম মিনিটে আন্টোনিও রুডিগারর উঁচু করে বাড়ানো বল বুক দিয়ে নামিয়ে শট নেন হাভার্টজ, এবারও তা ব্যর্থ করে দেন সিমন। ৩৭তম মিনিটে বক্সে ঢুকে কাছের পোস্টে উইলিয়ামসের নেওয়া শট ফিরিয়ে দেন নয়ার, যদিও অফসাইডের পতাকা তোলেন লাইন্সম্যান। তিন মিনিট পর ২৫ গজ দূর থেকে ওলমোর জোরাল শট ঝাঁপিয়ে ঠেকান ৩৮ বছর বয়সী নয়ার।
দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটে ভালো একটি সুযোগ হারান মোরাতা। বক্সে ইয়ামালের পাস পেনাল্টি স্পটের কাছে পান তিনি। সঙ্গে লেগে থাকা এক ডিফেন্ডারের চাপে ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়িয়ে মারেন আতলেতিকো মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড। ৫১তম মিনিটে ‘ডেডলক’ ভাঙেন পেদ্রির বদলি নামা ওলমো। বক্সে ঢুকে দারুণ পাস দেন ইয়ামাল, ছুটে গিয়ে প্রথম স্পর্শে ডান পায়ের শটে ঠিকানা খুঁজে নেন লাইপজিগ ফরোয়ার্ড ওলমো। আসরে তার দ্বিতীয় গোল এটি। ইউরোর ইতিহাসে প্রথম টিনএজার হিসেবে এক আসরে তিনটি অ্যাসিস্ট করলেন ১৬ বছর বয়সী ইয়ামাল।
জামাল মুসিয়ালা, নিকলাস ফুয়েলখুগের দুটি লক্ষ্যভ্রষ্ট শটের পর ৭০তম মিনিটে দুর্দান্ত সেভে ব্যবধানে ধরে রাখেন সিমন। বক্সের বাইরে থেকে হোবার্ত আনড্রিসের প্রচেষ্টা ঝাঁপিয়ে ঠেকান তিনি। ৭৭তম মিনিটে স্বাগতিকদের সামনে বাঁধ সাধে পোস্ট। ডান দিক থেকে সতীর্থের পাস পেয়ে বক্সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেলেও শট নেন ফুয়েলখুগ, গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়ে বল পোস্টে লাগে।
৮২তম মিনিটে দারুণ এক সুযোগ হারান হাভার্টজ। দুর্বল গোল-কিকে সিমন বল তুলে দেন প্রতিপক্ষের পেয়ে। এরপর পোস্ট ছেড়ে অনেকটা ওপরেও উঠে যান তিনি, সেই সুযোগ নিতে হাভার্টজ বক্সের বাইরে থেকে শট নিলেও বল ক্রসবারের ওপর দিয়ে চলে যায়। বিদায়ের ক্ষণ যখন ঘনিয়ে আসছিল, তখনই নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট বাকি থাকতে সমতার স্বস্তি ফেরে স্বাগতিক শিবিরে। মাক্সিমিলিয়ানের ক্রসে দূরের পোস্টে লাফিয়ে দারুণ হেডে বল ভেতরে পাঠান জসুয়া কিমিখ, দ্বিতীয়ার্ধে বদলি নামা ফ্লোরিয়ান ভিরৎজের শট পোস্টে লেগে জালে জড়ায়।
বুন্ডেসলিগার এবারের মৌসুম সেরা খেলোয়াড় ভিরৎজ ভীষণ প্রয়োজনের সময়ে গোল করে দলকে টেনে নেন অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে প্রথমার্ধের শেষ দিকে আরেকটি গোলের সুযোগ পান ভিরৎজ। টমাস মুলারের পাসে বায়ার লেভারকুজেন মিডফিল্ডারের শট পোস্টের সামান্য বাইরে দিয়ে যায়।
১০৭তম মিনিটে বক্সে মুসিয়ালার শট স্পেনের মার্ক কুকুরেইয়ার হাতে লাগলে পেনাল্টির জোরাল আবেদন করে জার্মানির খেলোয়াড়রা। রেফারির পেনাল্টি না দেওয়াটা ছিল বিস্ময়কর। ১১৭তম মিনিটে কিমিখের ক্রসে বক্সে ফুয়েলখুগের হেড ঝাঁপিয়ে আটকান সিমন।
ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়াবে বলে মনে হচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই জার্মানির জালে বল পাঠান মেরিনো। ওলমোর ক্রসে বক্সে ফাঁকায় হেডে লক্ষ্যভেদ করেন ৮০তম মিনিটে বদলি নামা এই মিডফিল্ডার। অতিরিক্ত সময়ের যোগ করা সময়ে মুসিয়ালাকে পেছন থেকে টেনে ধরে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন দানি কারভাহাল। একটু পরই বাজে শেষ বাঁশি। উচ্ছ্বাসে মাতে স্পেন।
জার্মানি শিবিরে তখন শুধুই একরাশ হতাশা। ঘরের মাঠের আসরে শেষ আট থেকে বিদায় নেওয়ার বিষাদ সঙ্গী হলো তাদের। ২০১৪ বিশ্বকাপের পর দলটির আরেকটি বড় টুর্নামেন্ট জয়ের অপেক্ষা বেড়ে গেল আরও। টনি ক্রুসের শেষটাও ভালো হলো না। এই ম্যাচ দিয়ে পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি ঘটল জার্মান তারকার। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ফ্রান্স অথবা পর্তুগালের মুখোমুখি হবে তিনবারের ইউরো জয়ী স্পেন।