লেখক: এম এ মাসুদঃ- রিকশা চালক বাবা চান মিয়ার এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নবরু বড়। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন সেই কবে! কিন্তু নবরুকে বিয়ে দিতে হিমসিম খাচ্ছিলেন চান মিয়া। ছেলে প্রতিবন্ধী হলেও বংশ রক্ষা করতে হবে বলে তাই হয়তো এতো তোড়জোড়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছেলের বউ হিসেবে জুটিয়েছিলেন এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েকে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না নবরুর। ভেঙে যায় তার সংসার। তাই ভবিষ্যতে কী হবে ছেলের এই ভেবে চিন্তার যেন কোনো অন্ত নেই ওর বাবা-মা’র।
একে তো বউ নেই, তারপর বাড়ি থেকে কিলো দুয়েক দূরে শহর। বাড়িতে থাকতে বললেও বাপ-মা’র কোনো বারণ মানে না নবরু । সেই সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠে সে। কোনো কিছু মুখে না দিয়েই পোশাক পরা শুরু করে ও । কোনো দিন পুলিশ, আবার কোনো দিন আনসার সদস্যের পোশাকটা পরে নেয় নবরু। ভুলে যায় না মাথায় ক্যাপ এবং পকেটে নেমপ্লেট লাগাতেও। এবার মুখে ফুঁ দেওয়ার বাঁশি ও দেড় ফুট সাইজের একটা লাঠি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে নবরু। যেন মহাব্যস্ত এক মানুষ ও । এবার শহরে যাবে বলে বাড়ির পাশের সরু পুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সে। মোটরসাইকেল, ভ্যান কিংবা অটোরিকশা পথ দিয়ে যেটাই যাক না কেন হাত তুলে সে। প্রতিবন্ধী বলে অবজ্ঞা করে না কেউ। তুলে নেয় তাতে। নামিয়ে দেয় পৌর শহরের মীরগঞ্জ বাজারে৷ নামার পরে সোজা চলে যায় এ্যানি হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে। দুই পরোটার সাথে ডাল ও ডিমের মামলেট দিয়ে সকালের নাস্তাটা সেরে নেয় নবরু। বিলের চিন্তা করে না সে। কারণ হোটেল মালিক এরশাদ প্রামাণিক আছেতো! সে জানে হোটেল মালিক তার প্রতি বড়ই সদয়।
নাস্তা সেরে উঠে আবার সবকিছু ঠিকঠাক করে নেয় নবরু। হোটেলের সামনে থাকা মোটরবাইকের গ্লাসে নিজেকে বারবার পরখ করে নেয় এবার। চোখের সানগ্লাস আর মাথার ক্যাপটা ঠিক আছেতো! এভাবে আয়নায় নিজের চেহেরাটা বেশ কয়েকবার দেখে নিয়ে ছুটে গন্তব্যের দিকে। উপজেলা সদরের এঅফিস-ওঅফিস,
এদোকান-সেদোকান ঘোরাঘুরি করতে করতে দুপুর গড়িয়ে হয় বিকেল। এবার বাড়ির পথ ধরে সে। পথে বাহিরগোলা এবং মীরগঞ্জ বাজারের প্রধান রাস্তায় এলোপাতাড়িভাবে রাখা পরিবহনে সৃষ্ট যানজটে নাকাল শহরবাসির কষ্ট দেখে মন মানে না নবরুর। তাইতো জট দূর করতে নেমে পড়ে সে। হাতে থাকা লাঠি ও মুখে বাঁশি বাজিয়ে সরিয়ে দেয় রিকশা, অটোরিকশাসহ নানা পরিবহন। ঠিক যেন অনেকটা ট্রাফিকের মতো দায়িত্ব পালন করে নবরু। এতে সাড়াও দেয় কেউ কেউ। কেউবা আবার শুনিয়ে দেয় তুলে আছাড় দেওয়ার মতো কথাও। চালকদের মুখে এমন অপ্রত্যাশিত কথা শুনে এবার খানিকটা চুপসে যায় নবরু। হয়তো মনে ব্যথা পেয়েছে বলে! নিজেকে সামলে নেয় নবরু। পরে আবার মন দেয় যানবাহন সরানোর কাজে। দায়িত্ব পালনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি দেখলেই দেয় লম্বা স্যালুট।
আবার কখনো কালো স্যুট ও সাদা শার্টের সাথে লাল টাইও পরে নবরু ৷ তবে এ পোশাকে যেদিন বের হয়, সেদিন আর যানবাহন সরানোর কাজ করে না ও। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেয় দিন। পায় দুই-চার-পাঁচ টাকা করে। প্যান্টের পকেটে থাকা মানিব্যাগ বের করে তাতে ভরে নেয় ওই টাকা। বেলা শেষে ফেরে মীরগঞ্জে। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে রাত বাজে ন’টা। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে নবরুর। রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে শোনা যায়, নবরু তুই কই? নবরু জবাব দেয়, ‘আব্বা, মুই মীরগঞ্জত। মোক আসি নিয়া যা।’