প্রশাসনে বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। শেখ হাসিনা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এবং বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) (অতিরিক্ত সচিব) মো.আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকি।
তিনি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সাবেক একান্ত সচিব ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের ক্ষমতাবান কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন। উপসচিব মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বড়োই সৌভাগ্যবান কর্মকর্তা। বিগত সরকারের আমলে তিনি প্রথমে ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গার একান্ত সচিব (পিএস)। পরে একই সরকারের অপর প্রতিমন্ত্রী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মীর্জা আজমের পিএস হন। পরের মেয়াদে আবার ফিরে আসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে। পিএস হন প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর তিনি পিএস হন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের। আওয়ামী লীগ সরকারের চার মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীর পিএস পদে থাকা মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বর্তমান সরকারের আমলে এখন একইমন্ত্রণালয়ে অন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফের পিএস। বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসেও প্রশাসন এখনো দুর্বৃত্তায়নের খোলসমুক্ত হতে পারেনি। সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। ঘুরেফিরে বিগত সরকারের আস্থাভাজনদেরকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে প্রশাসেনর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আজ সোমবার না হলে আগামীকাল নিয়োগ দেয়া হবে ৮ জেলার ডিসি। তবে এখনো অনেক কয়েকটি সচিব পদে শূন্য রয়েছে। দেশের ৫১টি জেলার ডিসি নিয়োগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক শেষ হয়নি, প্রকাশ করা হয়নি তদন্ত প্রতিবেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানাগেছে,অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টার পিএস পদে মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনকে পদায়ন করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তদবির সরকারের সরকারের সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। ওই সচিবের নিজের বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতির জোরালে অভিযোগ। রাজধানীর খ্যাতানামা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে এই সচিবের দায়িত্ব পালনকালে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরের (ডিআইএ) তদন্ত উঠে এসেছে। গত সরকারের আমলে জনপ্রশাসনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর আমলা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমনন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তার একান্ত সচিব ছিলেন একান্ত সচিব আবু নঈম মুহাম্মদ মারুফ খান। মারুফ খান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ও পরে সংসদ সদস্য বনে যাওয়া সাজ্জাদুল হাসানেরও একান্ত সচিব ছিলেন। আওয়ামী সরকারের আমলে শীর্ষ ক্ষমতাধর দুই আমলা পিএস থাকায় মারুখ খান নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসক পদও বাগিয়ে নেন এক সময়। তিনি এখন অন্তর্র্বতী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের পিএস। অন্তবর্তীকালীন সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশীদের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে মো. মাহমুদ হাসানকে। তার নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে ১৮ আগস্ট সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার পিএস হিসেবে যোগদান করেন মো. মাহমুদ হাসান। মো. মাহমুদ হাসানকে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার পিএস নিয়োগ দেয়ার পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগে (আইএমইডি) কর্মজীবি সমিতির পক্ষ থেকে গত ১৮ আগস্ট সমাজকল্যাণ উপদেষ্টাকে লিখিতভাবে আপত্তি জানানো হয়।ওই আপত্তিপত্রে আইএমইডি’র দুইজন পরিচালক, একজন উপ-পরিচালক, তিনজন সহকারি পরিচালক ও চারজন মূল্যায়ন কর্মকর্তা স্বাক্ষর করেন। আপত্তিপত্রে তারা জানান, মো. মাহমুদ হাসান একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। আইএমইডি’তে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একজন সাবেক সচিবের দুর্নীতির সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হাসান। ইতোপূর্বে তাদের দুইজনেরই দুর্নীতির খবর সমকালসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে আইএমইডি সহ সরকারী চাকরীজীবিদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। ফলে মো. মাহমুদ হাসানকে একজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দিলে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে। এরই প্রেক্ষিতে মো. মাহমুদ হাসানের মত একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন আইএমইডির কর্মকর্তারা। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, তৌফিক ই লাহী চৌধুরী, সালমান এফ রহমান ও কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর একান্ত সচিবরা এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলে রেখেছেন।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার সাবেক ইউএনও মিজানুর রহমান বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কর্মরত। তার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ। তিনি এখন উপদেষ্টার কাযালয়ে অফিস করছেন। প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিগত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারকদের একান্ত সচিব হওয়ায় তারা প্রভাব খাটিয়ে নিজের ব্যাচমেটদেরও চাকরি জীবনে অনেক ক্ষতি করেছেন। যারা মেধা তালিকার ওপরের দিকে কিংবা চাকরি জীবনে এসে অধিকতর দক্ষ আমলার পরিচিতি পেয়েছেন তাদের সব সময় কোণঠাসা করে রাখতেন। সরকারবিরোধী ট্যাগ লাগিয়ে শত শত কর্মকর্তার প্রাপ্য পদোন্নতি তারা কেড়ে নিয়েছেন। দফায় দফায় পদোন্নতিবঞ্চিত করে তাদের সামাজিক ও পারিবারিকভাবে চরম হেনস্তা করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, তাকে উপসচিব পদে চার দফায় পদোন্নতি বঞ্চিত করেছেন তারই কিছু ব্যাচমেট। এদের অনেকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে এখনো বহালতবিয়তে বসে আছেন।তাদের ক্ষমা নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ১৬ বছরে মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের একান্ত সচিব এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে প্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন তাদেরকেই জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হয়েছে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কয়েক স্তরে তদন্ত করা হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-পদমর্যাদার উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব (পিএস) দলবাজ আমলারা আবারো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) পদে নিয়োগ পেয়েছেন। আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন সেই কর্মকর্তাও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পিএস হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে।
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্বে রয়েছেন ১৭তম ব্যাচের শায়লা ফারজানা। যিনি বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া পুলিশের অতিরিক্ত আইজি এবং পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলামের স্ত্রী। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা তাকে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর থেকে বের করে দেন। তবে বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কে তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব এখনো বহাল আছে। এখানে তার অন্যতম সহযোগী হিসাবে আছেন উম্মে সালমা তানজিয়া ও শেখ মোমেনা মনি। প্রায় সাড়ে পাঁচশত নারী কর্মকর্তার এই গ্রুপের এডমিন মাত্র ৯ জনের হাতে জিম্মি। সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে এরা গ্রুপে পোস্ট দেওয়া ব্লক করে রাখেন। এখনো ব্লক আছে। প্রশাসনের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম ৬বছরের বেশি সময় কিভাবে রাজউকে প্রাইজপোস্টিং নিয়ে চাকরি করলেন, কারা তাকে এতদিন সেখানে বসিয়ে ঘুসের ভাগ নিয়েছেন তাদেরও চিহ্নিত করতে দাবি জানান বিগত দিনে এই ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন,বিগত সরকারের মন্ত্রীদের পিএসকে বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা কেন পিএস পদে নিয়েছেন সেটা উনারাই ভাল বলতে পারবেন। তবে এটুকু বলা যায়, উনারা প্রশাসনে আগের যে খোলস ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, সেখানে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে সবার কাছে। নব্বই দশক থেকে মুখচেনা, খাতিরের এবং তারপরে এসে পুরোপুরি দলীয় পরিচয়ধারীদের এই পদে নেওয়া শুরু হয়েছে।
সুত্র – ইনকিলাব