কেউ ময়দা মাখছেন, কেউ মেশিন ঘোরাচ্ছেন, কেউ মেশিন থেকে কাঁচা সেমাই নিয়ে রোদে মেলছেন তো কেউ আবার শুকানোর পর খাঁচিতে ভরছেন। এভাবেই ঈদকে ঘিরে বগুড়ার জেলা ব্রান্ডিংয়ে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী চিকন সেমাই কারখানার নারী শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। দুই ঈদকে সামনে রেখে সারাদেশে এই সেমাইয়ের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ব্যবসাীয়রা জানান, গত বছরের চেয়ে ময়দার দাম কম হওয়ায় এবার অনেক কারখানা মালিক স্বস্তিতে সেমাই বানাচ্ছেন। প্রতিকেজি সেমাই পাইকারিতে বিক্রি করছেন ৫২ টাকা ৬০টাকা পর্যন্ত। ঈদকে ঘিরে মাসজুড়ে জেলার সেমাই কারখানাগুলোতে তৈরি হওয়া কয়েক কোটি টাকার চিকন সেমাই চলে যায় বগুড়ার বাইরে।
গতবছর বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবছর সেই ময়দা প্রতি বস্তায় প্রায় ৬শ’ টাকা কম হওয়ায় তারা এবছর নতুন করে উৎপাদনে এসেছে। প্রতি বছর রমজানের কয়েকদিন আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চিকন সেমাইয়ের অর্ডার আসতে শুরু করে। বছরের অন্য সময় এই পেশার সাথে যারা জড়িত তারা অন্য কাজ করলেও সবেবরাতের পর থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে সেমাই তৈরিতে। ৯০ দশকের পর বগুড়ার এই সেমাইপল্লীগুলোতে মেশিনের মাধ্যমে সেমাই তৈরি শুরু হয়। মেশিন চালানো থেকে শুরু করে খাচায় তোলা পর্যন্ত কাজ করে এলাকার নারীরা সংসারের যোগান দিলে চলেছেন।
বগুড়ার এই চিকন সেমাই শুধুমাত্র বগুড়া সদর এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন তা ছড়িয়েছে কাহালু, শাজাহানপুর ও গাবতলী উপজেলাতেও। ঈদকে ঘিরে এসব উপজেলায় দেড় থেকে ২ শতাধিক কারখানায় সেমাই তৈরি হয়। এরমধ্যে বগুড়ার সদরের বাঁশবাড়িয়া, কালসিমাটি, শাজাহানপুর উপজেলার বেজোরা, ঢাকন্তা, শ্যাওলাগাঁতিপাড়ায় কাজ চলছে সেমাই তৈরির। এসব এলাকার আশেপাশের গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারীরা সারাবছর অন্যকাজ করলেও একমাসের জন্য সেমাই তৈরির কাজ করেন। রোদ ও বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে এই শ্রমিকদের পারিশ্রমিক। রোদ ও বিদ্যুৎ থাকলে প্রতিদিন ৩০০ টাকা মুজুরী পান।
বগুড়ার সাবগ্রামের বাঁশবাড়িয়া এলাকার সরকার রাইচ এন্ড ফ্লাওয়ার মিল চত্বরে প্রতিবছর ঈদের সময় জমজমাট হয়ে ওঠে সেমাই তৈরির কার্যক্রম। এই মিলে প্রায় প্রতিবছর কাজ করেন পাশের রবিবাড়িয়া এলাকার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মলি বেগম, তার মা মমতা। আরও কাজ করেন বেদেনা, বিলকিস, আসমা, জরিনা। তারা জানান, বছরের বাকি সময় চাতালে ও বীজের কাজ করলেও এ্ সময় রোদে পুরে সেমাই তৈরির কাজ করে দিনশেষে ৩০০ টাকা পান। কষ্ট হলেও উৎসবে সংসারে বাড়তি কিছু টাকা আসে বলেওই তারা এই কাজ করেন। তারা এই কাজের সময় প্রার্থণা করেন যেন আকাশ খারাপ না হয় এবং দিনভর যেন বিদ্যুত চলে না যায়। কারণ সেমাই তৈরি এবং শুকানো দুটোই এই দুই ব্যবস্থার সাথে জড়িত।
এই একই কারখানার ম্যানেজার কাফি জানান, অর্ডার অনুয়ায়ী প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৭ বস্তার সেমাই তেরি হচ্ছে এখানে। গতবছর প্রতি বস্তা ময়দার দাম ছিল ১৮ থেকে ২ হাজার টাকা। এবছর দাম কমেছে ৬৫০ টাকা। তারা ময়দা কিনছেন ১৩৫০(৩৭ কেজির বস্তা) টাকায়। তাদের এই কারখানায় ৭জন নারী শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিকেজি সেমাই পাইকারিতে বিক্রি করছেন ৫২ টাকা কেজিতে। বগুড়া ছাড়াও তাদের এই সেমাই চলে যাচ্ছে বগুড়া, জয়পুরহাট, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, খুলনা ও ঢাকায়। তিনি আরও জানান, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, সারাবছর চাহিদা কমে যাওয়ায় সেমাই তৈরির অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা ধরে রেখেছেন তারা অন্য ব্যবসার সাথে মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে এই ব্যবসা করছেন।