আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে কয়েক সপ্তাহ ধরে থেমে থেমে চলছে শ্রমিক অসন্তোষ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পোশাক কারখানায় বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। এই অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ক্ষমতার পালাবদলে ঝুট ব্যবসা দখল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুসারীদের মাধ্যমে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা তৈরি করছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের পোশাকখাত।
শ্রমিকদের পক্ষে করা দাবিগুলো কতটা যৌক্তিক? নাকি শ্রমিকদের আড়ালে কোনো চক্র অস্থিতিশীল করে তুলতে চায় পোশাকখাতকে, বিব্রত করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকারকে? যার পেছনে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা জড়িত বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই চক্রান্তকারীরাই শ্রমিক নামধারী কিছু দুর্বৃত্তদের দিয়ে পোশাক শিল্পে অস্তিরতা সৃষ্টি করেছে।
গতকাল মঙ্গলবার আশুলিয়ায় বার্ডস গ্রুপের পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রী ও পথচারীরা। এতে সড়কের নবীনগর থেকে বাইপাইল হয়ে কবিরপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিমি যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্রামুখী সড়কে নবীনগর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত ৩ কিমি ও ঢাকামুখী লেনে কবিরপুর থেকে বাইপাইল ১০ কিমি সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় সকাল থেকেই কর্মব্যস্ততা বাড়তে থাকে। তবে সড়ক অবরোধের কারণে এ এলাকায় আসা পথচারী ও যানবাহনকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অবরোধের কারণে নবীনগর ত্রিমোড়কে কেন্দ্র করে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশাপাশি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কেও জট সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আরিচামুখী সড়কে প্রায় নবীনগর থেকে সাভারের দিকে প্রায় ১০ কিমি ও ঢাকামুখী সড়কে নবীনগর থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় ২ কিমি যানজট সৃষ্টি হয়।
শ্রমিকরা জানান, ২৭ আগস্ট বার্ডস গ্রুপের আরএনআর ফ্যাশন, বার্ডস গার্মেন্টস লিমিটেড, বার্ডস ফেডরেক্স লিমিটেড এক নোটিশের মাধ্যমে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। সেসময় পুলিশ, সেনাবাহিনী ও মালিকপক্ষের উপস্থিতিতে সব পাওনা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করা হবে বলে জানানো হয়। শ্রমিকরা বকেয়া বেতন ও সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণের জন্য সোমবার সকালে কারখানায় এলে মালিকপক্ষ ফের ৩ মাসের সময় চায়। পরে শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতনের টাকা ও সার্ভিস বেনিফিটসহ ক্ষতিপূরণ দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রাখেন।
এদিকে শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শ্রমিকদের বুঝানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বার্ডস গ্রুপ থেকে ভাউচারের মাধ্যমে লেবার ফেডারেশনের নামে টাকা নেওয়ার কপি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে শ্রমিক নেতারা কথা বলতে রাজী হয়নি। এমনকি বার্ডস গ্রুপের কেউ কথা বলতে চায়নি।
শ্রমিক নেতারা বলেন, বিভিন্ন সময় আন্দোলনকারী শ্রমিকরা যেসকল দাবী-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করছে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুসারীরা মূলত শ্রমিকদের উস্কে দিচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য মুরাদ জং এবং আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামের অনুসারীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর দেশত্যাগ করায় তারাও আত্মগোপনে চলে যায়। এরপর ছাত্র হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় একের পর এক মামলায় তাদের আসামি করা হয়। তবে সাইফুল ও মুরাদ জং আত্মগোপনে থাকলেও তাদের অনুসারীরা বিভিন্ন পরিচয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও পোশাক শিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। তারা েিজদের পরিচয় পাল্টিয়ে বিএনপির সাথে মিশে অরাজকতার সৃষ্টি করছে এমন খবরও পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আশুলিয়া এলাকার একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানাগেছে, বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্থানীয় নেতা যারা ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত এবং শিল্প এলাকায় চাঁদাবাজি করত তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পতনের পর নতুন চাঁদাবাজরা শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটার চেষ্টায় আছে।
বিভিন্ন শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে যে আন্দোলন হচ্ছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকরাও কিছু দাবি আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করছে। আর এসব ছোটখাটো দাবীর আড়ালে আসলে সুবিধাভোগী গ্রুপ শ্রমিকদের উসকে দিয়ে রাস্তায় নামাচ্ছে।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন, আন্দোলনকারী শ্রমিকরা যেসকল দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করছে তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিকদের উস্কে দেয়ার পিছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুসারীদের হাত রয়েছে ধারনা তাদের। তবে বিভিন্ন কারখানার সাধারণ শ্রমিকদের কথা হলো, যারা মাঝেমধ্যেই গার্মেন্টস সেক্টরে এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়, তাদের অনেকেই নাকি গার্মেন্টস শ্রমিক নয়। এরা বেশিরভাগই বহিরাগত। শ্রমিক নামধারী দুর্বৃত্ত। তাদেরকে কাজে লাগাচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতাদের কিছু কারখানার কর্মকর্তারা।
সচেতনমহল মনে করেন, সম্প্রতি পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি তুলে আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়। কারখানা, পরিবহণ ভাঙচুরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কতিপয় শ্রমিক নামধারী উচ্ছৃঙ্খল দুর্বৃত্তদের মারমুখী আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রমিকদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে মাস শেষে বেতন, ওভারটাইম মজুরি, উৎসব ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে নিজ পরিবারকে আর্থিক জোগান দেওয়ার বিষয়টি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইন বিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, আশুলিয়া পোশাক শিল্পের অস্থিরতা প্রায় শেষ হয়ে উঠেছিল। সব গার্মেন্টসেই স্বাভাবিকভাবে কাজ চলছিল। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকরাও বেতন বৃদ্ধি ও তাদের দুইজন শ্রমিক নিখোঁজ, একজন শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে বিক্ষোভ নতুন করে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। এরমধ্যে সোমবার এক শ্রমিক নিহত হয়। তিনি ধারনা করছেন, এই অসন্তোষের পিছনের আওয়ামীপন্থী কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনো হাত থাকতে পারে। এ ঘটনার সঠিক তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে।
তবে এসব বিষয়ে শিল্পপুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলমের সাথে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এছাড়া শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যৌথ বাহিনীর টহল কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।
সুত্র- ইনকিলাব