অনাবৃষ্টিতে আমন চাষ ব্যহত, মুনাফা লুটতে ব্যস্ত সেচ পাম্প মালিকরা
এম এ মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ(গাইবান্ধা) প্রতিনিধি: দশক তিনেক আগেও যেখানে শ্রাবণের অবিরাম বৃষ্টিতে নদী, নালা, খাল, বিল হয়ে পড়তো টইটম্বুর, সেখানে জলবায়ুর পরিবর্তনে শ্রাবণের শেষ হতে চললেও দেখা নেই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে কোনো বৃষ্টির। অনাবৃষ্টি আর খাঁ খাঁ রোদ্দুরে মাঠ, ঘাট ফেটে হয়ে পড়েছে চৌচির। বাধ্য হয়েই বিভিন্ন সেচ পাম্পের সাহায্যে পানি নিয়ে আমন রোপণ শুরু করেছেন চাষিরা। সুযোগ বুঝে তার সদ্ব্যবহার করছেন সেচ পাম্প মালিকরা। পানির দাম বাড়িয়ে দিয়ে মুনাফা লুটতে ব্যস্ত মালিকরা আর বিপদে পড়েছেন তারা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, চলতি মৌসুমে আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ হাজার ১৬২
হেক্টর। প্রণোদনা হিসেবে ১ হাজার ৭২০ জন পেয়েছেন সার ও বীজ এবং হাইব্রিড জাতের ধান বীজ পেয়েছেন ৮০ জন চাষি। ভালো ফলন পেতে বীজতলায় ফেলানো চারার বয়স ২৫ দিন হলে তা জমিতে রোপণ করা জরুরি। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তাই সেচ পাম্পের সাহায্যে চাষিদের চারা রোপণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে কালবেলাকে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। অধিদপ্তর আরো জানায়, উদ্ভাবিত জাতগুলো খরা সহনশীল হওয়ায় দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই চাষি ভাইদের। শুধু জমিতে চারা রোপণ এবং শীষ বেরোনোর সময় সেচ দিতে পারলেই ফলনে কোনো ঘাটতি হবে না তাদের।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর, রংপুর-এর সহ-আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, গত বছর একই সময়ে রংপুর অঞ্চলে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ২শ ৯৪ মিলিমিটার এবং চলতি বছর একই সময়ে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৯২ মিলিমিটার, যা গত বছরের তুলনায় ১শ ২ মিলিমিটার কম। আর এর প্রভাব পড়েছে আমন চাষে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার কয়েকটি চরাঞ্চল এবং ঘগোয়া, চাচিয়া মীরগঞ্জ, বামনজল, দোলাপাড়া, হলহলিয়া এলাকার নালাসহ অধিকাংশ নালার পানি শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। কাঠফাটা রোদের সাথে মাঝে মাঝে বইছে মরুভূমির লু হাওয়ার মত উঞ্চ হাওয়া। অবস্থা দৃষ্টে এ বর্ষাকালেও যে কারো মনে পড়বে কবি ফজলুর রহমানের ‘গ্রীষ্মের দুপুরে’ কবিতার সেই লাইনগুলোর কথা-
রোদ যেন নয়,
শুধু গনগনে ফুলকি।
আগুনের ঘোড়া যেন
ছুটে চলে দুলকি।
বর্ষার শেষ দিকেও জমিতে পানি না থাকায় চারা নিয়ে বিপদে পড়েছেন কিষাণ-কিষাণীরা। অনেকেরই বীজবপণ থেকে বলান দেওয়া পর্যন্ত চারার বয়স হয়েছে প্রায় ৫০ দিনের মত। ফলে চারা রোপণ নিয়ে তড়িঘড়ি করছেন তারা। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন মুনাফালোভী পানির পাম্প মালিকরা। তারা বাড়িয়ে দিয়েছেন পানির আকাশচুম্বী দাম। বাঁধাগ্রস্থ করছেন চারা রোপণ।
কিষাণ-কিষাণীরা বলছেন, ডিজেল ইঞ্জিন চালিত ছোট্ট মেশিনে যেখানে ঘন্টায় আধা লিটার তেল লাগে, সেখানে মালিকরা প্রতি ঘন্টায় দাম নিচ্ছেন ২শ টাকা। আর বিদ্যুৎ চালিত মটর মালিকরাও নিচ্ছেন ঘন্টায় ঠিক ওই একই টাকা।
অন্যদিকে, উপজেলায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সেচ পাম্প রয়েছে ৫৬টি। পাম্পগুলোতে কার্ড সিস্টেমে ঘন্টায় ১শ ২০ টাকায় পানি নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাম্প চালকরা শুধু বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে কার্ড দিয়ে পানি নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন। আর গত বোরো মৌসুম তো বটেই, চলতি আমন মৌসুমেও কার্ড দিয়ে পানি নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না অধিকাংশরা । এমন অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিষাণ-কিষাণীদের। তাদের ভাষ্য, চালকরা চারা রোপণের জন্য কেউ নিচ্ছেন ৪শ টাকা, আবার ২শ মিটার দূরেই কেউ বা নিচ্ছেন ৫শ টাকা। আবার, এ দুর্যোগের সময়ও কেউ কেউ বন্ধ রেখেছেন বরেন্দ্রর সেচ পাম্পগুলো।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সময়ে পানি নিয়ে এমন খামখেয়ালিপনার কারণ জানতে চাইলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প, সাদুল্যপুর জোনের সহকারী প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘৫৬ টি পাম্পের মধ্যে মাত্র একটি পাম্প বৈদ্যুতিক কারণে বন্ধ রয়েছে। শীগগির তা চালু করা হবে এবং চাষিদের সাথে বৈষম্য করলে অভিযোগ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রাশীদুল কবির জানান,‘’আমাদের এ উপজেলার আমন ধানের জাতগুলো খরা সহিষ্ণু। দুর্যোগপূর্ণ এ আবহাওয়ায় অন্যান্য পরিচর্যা ঠিক রেখে শুধু রোপণের সময় এবং শীষ বেরোনোর সময় সেচ দিলে আশাকরি ধানের ফলনে কোনো ঘাটতি হবে না।’