দেশে প্রতিদিন ১ হাজার ৩৪০টি অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। সে হিসাবে ঘণ্টায় অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে ৫৬টি। দেশে অপরিণত শিশু জন্মে প্রতিরোধ কার্যক্রমে গতি নেই। এখনো বছরে সাড়ে চার লাখ অপরিণত শিশুর জন্ম হচ্ছে। অপরিণত শিশু জন্মের হারে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষে। এটি প্রতিরোধে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যথাযথ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাড়াতে হবে তদারকি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক সেমিনারে এ তথ্য জানান আলোচকেরা। বিএসএমএমইউতে গতকাল শনিবার সকালে সেমিনারটির আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, সাধারণত মাতৃগর্ভে ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহ থাকার পর শিশুর জন্ম হয়। জন্মের সময় নবজাতকের ওজন থাকে আড়াই থেকে চার কেজি পর্যন্ত। ৩৭ সপ্তাহের আগে শিশুর জন্ম হলে এবং তার ওজন আড়াই কেজির কম হলে তাকে অপরিণত নবজাতক বলা হয়। বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের হার ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। সংখ্যার বিবেচনায় বছরে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০টি শিশু অপরিণত বা মাতৃগর্ভে ৩৬ সপ্তাহ বয়সের আগে ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এতে শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে। অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া শিশুদের শারীরিক ও স্নায়বিক নানা জটিলতাও দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে সেরিব্রাল পালসি, বিকাশগত বিলম্ব এবং অক্ষমতা, মৃগীরোগ ও অন্ধত্ব অন্যতম।
সেমিনারে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী (মা ও শিশুস্বাস্থ্য) ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান। তাঁর প্রবন্ধে উঠে এসেছে, মাতৃগর্ভে আট সপ্তাহের পর থেকে শিশুর বিভিন্ন অঙ্গের গঠন শুরু হয়। ৩৬ সপ্তাহে গিয়ে শিশুর শারীরিক ও মস্তিষ্কের গঠন শেষ হয়। শিশু পূর্ণতা পায় ৪০ সপ্তাহে। তবে ৩৬ সপ্তাহের আগেই দেশে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর জন্ম হয়। বাংলাদেশে কম ওজন নিয়ে শিশু জন্মের হার ২৩ শতাংশ। স্বল্প ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা বছরে ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০। অপরিণত শিশুর স্বল্প ওজনের হারও ২৩ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ১৫৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। বছরে ২৪ হাজার ৯৫৭টি শিশুর মৃত্যু হয় অপরিণত জন্মের কারণে। সে হিসাবে দিনে ৬৮টি নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে অপরিণত জন্মের কারণে।
অপরিণত নবজাতকের জন্ম প্রতিরোধে দেশে চলমান কার্যক্রমের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএমএমইউর নিওন্যাটোলজি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. আব্দুল মান্নান। তিনি জানান, অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে মায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে মনোযোগ দেওয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। অপরিণত শিশুর জীবন রক্ষায় মাতৃদেহের উষ্ণতায় নির্দিষ্ট সময় রেখে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। আর স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিটের (স্ক্যানু) সেবাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অপরিণত ও স্বল্প ওজনের শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৬৮টি কেএমসি সুবিধাসংবলিত স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র রয়েছে। এতে সেবা নেওয়া মা ও নবজাতকের সংখ্যাও বেড়েছে। চলতি বছরেও প্রায় ২০ হাজার শিশুকে কেএমসি সেবা দেওয়া হয়েছে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অপরিণত শিশু এবং স্বল্প ওজনের শিশুদের ৫ শতাংশের কম এসব সেবার আওতায় আসছে।
তাঁর প্রবন্ধে উঠে এসেছে, মাত্র ১৬ শতাংশ অপরিণত শিশু কেএমসির সেবা পাচ্ছে চার দিনের বেশি, আর ৮৪ শতাংশ পাচ্ছে তিন দিনের কম। কেএমসির সুবিধা সবচেয়ে কম বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে, মাত্র ৯ শতাংশ। অন্যদিকে স্ক্যানু সেবার সংখ্যা চলতি বছর কমে এসেছে।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) ডা. লায়লা আরজুমান্দ বানু বলেন, ‘গর্ভকালীন কোনো সংক্রমণ, জরায়ু ছোট থাকলে বা জরায়ুতে কোনো টিউমার থাকলে অপরিণত শিশু হতে পারে। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অস্বাভাবিকতা, কিডনির সমস্যা, গর্ভাবস্থায় ওজন বেড়ে যাওয়া, অত্যধিক ওষুধ সেবনে অপরিণত নবজাতকের জন্ম হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে অপরিণত শিশু জন্মের কারণ থাকে না, উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিতে হয়। অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ডা. মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বাইরের অধিকাংশ চিকিৎসাকেন্দ্রে গর্ভাবস্থায় কম ওজন ও অপরিণত শিশু শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। অনেক হাসপাতালে ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র নেই। বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের অবস্থা আরও নাজুক। তারা কোনো তথ্য দিতে চায় না।’