কংকনা রায়, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলাজুড়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি) রোগ। সামনে কোরবানী ঈদ। আর ঈদের আগে আমন ভাইরাসের সংক্রমণ। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিভেষধক না থাকায় দিশেহারা খামারী ও গৃহস্থরা। পড়েছে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
এদিকে খামারীদের অভিযোগ, রোগটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লেও অফিস ছেড়ে মাঠে দেখা মিলছে না প্রাণী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ফলে গ্রামের পল্লী চিকিৎসক দিয়ে চলছে চিকিৎসা সেবা। এতে গরু সুস্থ না হলে পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে।
অপরদিকে উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের উদ্যোগে রোগটির বিষয়ে সচেতনতামূলক সভাসহ লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও তাদের অফিসিয়্যাল ফেসবুক পেজে ও ওয়েবসাইটে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার (৭ মে) দুপুরে উপজেলা প্রাণীসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়। ভ্যানে ভ্যানে এ রোগে আক্রান্ত গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গৃহস্তসহ খামারীরা। হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক ও কর্মচারীরা চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুলবাড়ী উপজেলায় প্রায় অর্ধ সহস্রাধিকের বেশি গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সরকারিভাবে এ বিভাগ থেকে আক্রান্ত গরুকে চিকিৎসা প্রদানসহ পরামর্শ দেওয়ার কথা থাকলেও তারা কেউ মাঠে আসেননি বলে দাবি কৃষক ও গৃহস্থদের।
এদিকে উপজেলার অনেক খামারি ও কৃষক ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ’ রোগে আক্রান্ত গরু বাধ্য হয়ে খুবই কম দামে স্থানীয় কসাইদের কাছে বিক্রি করছেন। কেনোনা বেশি আক্রান্ত হলে গরুগুলো মারা যাচ্ছে।
উপজেলার শিবনগর, বেতদিঘী, আলাদীপুরসহ বেশি কিছু ইউনিয়নের অধিকাংশ বাড়িতেই এ রোগ দেখা দিয়েছে। ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের পর গ্রাম। গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতির এ পরিস্থিতিতে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন মালিকরা।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে চত্বরে কথা হয় পৌরএলাকার তেঁতুলিয়া গ্রামের কায়সার আলীর সাথে। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে বেশ কয়েকটি গরু আছে। যাদের মধ্যে একটি ছোট বাছুরের গায়ে লাম্পি রোগ দেখা গেছে। পরে বাছুরটি হাসপাতালে এনে জানতে পারি বাছুরটি লাম্পিসহ বেবিসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিয়েছে।
সুজাপুর গ্রামের ফেরদৌসি বেগম বলেন, তার চারটা গরুর মধ্যে একটি বড় গরুর গলার নিচে ফুলে গেছে এবং সারা গায়ে ফোসকা বের হয়েছে। গরুটির অবস্থা খুবই খারাপ। শরীর পচে গর্ত হয়ে যাচ্ছে। গরুটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে একটু সুস্থ আছে।
চকচকা গ্রামের রতন শিং বলেন, আমার একটি গরু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত জেনে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। বর্তমানে গরুটির অবস্থা নাজুক। তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
সাহাবাজপুর গ্রামের গরু খামারী নজরুল ইসলাম বলেন, সামনে ঈদ আর এসময় গরু লাম্পি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ঈদে লোকসান গুণতে হবে। তিনি এ রোগ প্রতিরোধে দ্রুত সরকারিভাবে প্রতিভেষধক তৈরির দাবি জানান।
উপজেলার ইউনিয়নের পলিশিবনগর গ্রামের ফয়জুর আলী, আবু বক্কর ও মংলা শেখ জানান, তাদের প্রত্যেকের একটি করে গরু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া এ গ্রামের সিংহভাগ বাড়িতে এ ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে কোনো চিকিৎসককে এখন পর্যন্ত কোনো গ্রামে ঘুরতে দেখা যায়নি। রোগটি ভয়াবহ ভাবে ছড়ালেও তাদের কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। গ্রাম থেকে হাসপাতালে গরু নিয়ে যেতে অনেক খরচ ও ঝামেলা। তাই বাধ্য হয়ে হাতুড়ি ডাক্তার দিয়েই কাজ চালাতে হচ্ছে।
উপজেলার বেতদিঘী ইউনিয়নের পল্লী চিকিৎসক রেজাউল আলম বলেন, গত এক মাস যাবত লাম্পি স্কিন রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই কয়েকটি করে এমন রোগে আক্রান্ত গরু দেখছি। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ দেখে আক্রান্ত পশুকে পেনিসিলিন, এন্টি হিস্টামিন এবং জ্বর হলে প্যারাসিটামল দিলে কিছুটা উপকার পাওয়া যায়। তবে অবস্থা গুরুত্বর অবস্থা হলে উপজেলা প্রাণীসম্পদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড মো. রবিউল ইসলাম বলেন, উপজেলায় লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে এবং এ রোগ সম্পর্কে গৃহস্থ ও খামারীদেরকে সচেতন করতে লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক সভা সেমিনার করা হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের সরকারি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। যদি কোনো কেনো গরুর এ রোগ দেখা দেয় তবে গৃহস্থ বা খামারীরা সে ব্যবস্থাপত্র দেখে প্রাথমিকভাবে ওষুধ দিতে পারবেন। প্রতিভেষধক তৈরিতে সরকার কাজ করছে। দ্রুতই এ রোগের প্রতিভেষধক বাজারে আসবে। তবে কিছু কোম্পানি ইতোমধ্যে প্রতিভেষধক বাজারজাত করেছে। তার মূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকদের নাগালের বাহিরে চলে গেছে।
তবে কোনো গরু গুরুত্বর আক্রান্ত হলে দ্রুত সে গরুকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।