নিউজ ডেস্কঃ- উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেশি র্যাংকিং । দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে। নতুন সরকারি তথা রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীসংকট না হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংকটে পড়ছে। নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্মার্ট অবকাঠামো, শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, মানসম্মত শিক্ষক এবং অনেক কিছু নিয়ে হাজির হলেও তারা শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।
নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিরা লক্ষণীয় বিনিয়োগের পরও ফিডব্যাক না পেয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাঁড়াতে পারছে না। আবার পুরনো ও নামি কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর চাপ সামাল দিতে পারছে না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি সুপারিশ করেছে।
মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য দেশীয় র্যাংকিং প্রথা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য নিয়ে করা প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরের পর সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) র্যাংকিং’ ও ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাংকিং’ বেশি পরিচিত। তবে এ দুই র্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব কম। যারা এসব সিস্টেমে অংশ নেয় না, তারা কোনো র্যাংকিংয়েই থাকে না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানদন্ডবিষয়ক জটিলতা রয়েছে। ফলে তারা র্যাংকিংয়ে খুব বেশি এগোতে পারে না।
ইউজিসি বলছে, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানের র্যাংকিংয়ের মানদ-ে বিদেশি ও দেশি শিক্ষার্থীর অনুপাতসহ বেশ কিছু বিষয় থাকে। সেখানেই পিছিয়ে পড়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসব র্যাংকিং পুরোই কাগজপত্রনির্ভর হওয়ায় বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তা মিলে না। ফলে অংশগ্রহণকারী দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামনে আসতে পারে না। অথচ দেশের বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ ভালো করছে।’
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য দেশীয় র্যাংকিংব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি। এটা জাতীয় বা অভ্যন্তরীণভাবে হতে পারে। বিশ্ব র্যাংকিংয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রেও হতে পারে, আবার আলাদাভাবেও হতে পারে। হয়তো এ কাজের সমন্বয় করবে ইউজিসি। কিন্তু এজন্য শিক্ষক, শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি নিরপেক্ষ প্যানেল থাকবে। তারাই মূল কাজটা করবে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানের করা র্যাংকিংয়ে আমরা মানদ-ের কারণে পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না। র্যাংকিং থাকলে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের ভালো মানের কারণে এগিয়ে আসতে পারে। সব বিশ্ববিদ্যালয় মান বাড়ানোর জন্য তৎপর হতে পারে। আমাদের অভ্যন্তরীণ র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, প্রকাশনা, গবেষণা প্রকল্প, শিক্ষক, শিক্ষার্থী প্রভৃতিবিষয়ক মানদ- থাকতে পারে। র্যাংকিং থাকলে আমরাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারব।’
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বনিম্ন সুদে শিক্ষাঋণের সুপারিশ করা হয়েছে। স্নাতকপর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এ ঋণ পাবে। সরকার এ-সংক্রান্ত ফান্ড দিলে তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর উদ্যোগ নেবে ইউজিসি।
গবেষণায় জোর দেওয়ার জন্য করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআর বা আয়ের একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে ইউজিসি। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সিএসআর ফান্ডের টাকা যত্রতত্র খরচ করে। তাতে সমাজ বা রাষ্ট্রের খুব একটা উন্নয়ন হয় না। সরকার যদি সিএসআর ফান্ডের একটা অংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করে, তাহলে দেশে গবেষণা খাত জোরদার হবে। নতুন নতুন উদ্ভাবনে এগিয়ে যাবে দেশ।
বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউজিসির জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ১২ হাজার ২৬২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। গবেষণায় বরাদ্দ মাত্র ১৭৪ কোটি টাকা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা তার প্রতিটি বিভাগ খুবই কম অর্থ পায়; তা দিয়ে গবেষণা করা দুরূহ ব্যাপার। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার ফান্ড যেহেতু তাদের নিজেদের আয় থেকেই দিতে হয়, সে কারণে আট-দশটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্যরা গবেষণা বলতে গেলে করতেই পারে না। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য গবেষণার জন্য বিদেশি ফান্ড পায়। তারা গবেষণায় সাফল্যও দেখাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্যানেল তৈরি নিয়ে নানা সমালোচনা হয়। বিশেষ করে উপাচার্যরা যদি কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়ে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিতে জড়ান, তখন সমালোচনা বেশি হয়। আবার প্যানেল তৈরি করতে গিয়েও সময়ক্ষেপণ হয়। অনেক সময়ই দেখা যায় উপাচার্যের পদ শূন্য। এজন্য যোগ্য ও স্বনামধন্য শিক্ষকদের নিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইউজিসি একটি পুল করার সুপারিশ করেছে। সেখান থেকে সরকার তাদের পছন্দমতো একজনকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবে। এ পুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও কাজে লাগাতে পারবে।
ইউজিসির ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদনে প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি নিয়ে জাতীয়ভাবে একটা নীতিমালা করার সুপারিশ করেছে। বিশ্ববিদ্যালগুলোর প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রায়ই চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ছে। নীতিমালা না থাকায় চুরির বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। অনেকেই কপি-পেস্ট করে তাদের প্রকাশনা শেষ করছেন। সে প্রকাশনা দিয়ে তারা পদোন্নতিসহ নানা সরকারি সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। এতে উচ্চশিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটছে না।
কমিশনের সুপারিশে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবরেশনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীই তত্ত্বীয় পড়ালেখা শেষ করার পরও বাস্তব কাজের ধারণা পায় না। এজন্য শিক্ষার্থীদের জব প্লেসমেন্ট জোরদার করা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের ইন্টার্ন করার সুযোগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল, ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি, সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল করার সুপারিশও করেছে ইউজিসি।