দেশের শীর্ষ ছয় প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত ২৩৪ টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরও অনেক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ালেও সেই নথি পায়নি সমকাল। ফলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো কত শতাংশ বাড়িয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অভিযোগ রয়েছে, নির্ধারিত দরের চেয়ে বাজারে অনেক ওষুধ বেশি দামেও কেনাবেচা চলছে।
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে আরও ১০ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম বাড়াতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করেছে। এদের কেউ কেউ ওষুধের দাম সমন্বয় না করলে উৎপাদন বন্ধের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকরা বলছেন, দফায় দফায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও ডলারের দর বাড়ার কারণে ওষুধের বাজারে প্রভাব পড়েছে। ফলে দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। অন্যদিকে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও বিধিমালা না থাকায় কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে চলছে। গুণগত মান না বাড়িয়ে ওষুধের দাম বাড়ানোয় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এখনও মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশই খরচ হয় ওষুধের পেছনে। সেখানে এক লাফে এত দাম বাড়ার কারণে বিপাকে পড়েছেন ক্রেতারা। রোগীদের অনেকেই প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারছেন না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা খরচের ৬৪ শতাংশ ওষুধে ব্যয় হয়।
দেশে অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় ২১৯টি ওষুধ রয়েছে। এর মধ্যে ১১৭ ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অন্যগুলোর দর নির্ধারিত হয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবনার ভিত্তিতে। গত জুলাইয়ে অত্যাবশ্যকীয় ৫৩ ওষুধের দাম বাড়িয়েছিল সরকার।
কে কত দাম বাড়াল
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শীর্ষ ছয় কোম্পানির ওষুধের দাম সর্বোচ্চ বেড়েছে। সবার শীর্ষে রয়েছে অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠান বাড়িয়েছে ৫২টি ওষুধের দাম। তাদের ওষুধের দাম সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কোম্পানিটির উৎপাদিত প্রতি পিস ১০ টাকা দামের অস্টোজেন প্লাস ইএফ ট্যাবলেট এখন ১৫ টাকা। ১৯ টাকা দামের ফ্লুক্স ২৫০ মিলিগ্রাম ইনজেকশন ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে ২৫ টাকা করা হয়েছে। একটি কনভুলেস সিআর ২০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের দাম ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে এখন ৮ টাকা করা হয়েছে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাস লিমিটেড ৪৭টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওষুধের দাম সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০৫ টাকার ওটিক্লর পাউডার ফর সাসপেনশন ১০০ মিলিলিটার বোতল এখন ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জিফ্লু ১০ সিরাপের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আগে ৩০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৪০ টাকা। সেফোটিম ইনজেকশনের দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে। ১৫০ টাকার ওষুধটি এখন ১৭০ টাকা।
এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ৪৬টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওষুধ সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। কার্ডোবিসএ২.৫ প্রতি পিস ৬ টাকা থেকে ৮ টাকা করা হয়েছে। কার্ডন ২৫ এফসি ট্যাবলেট ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা করা হয়েছে। আগে ৪ টাকা ৫০ পয়সা ছিল। ন্যাপ্রক্স সাসপেনশন সিরাপ ২৮ শতাংশ বেড়ে ৭০ থেকে ৯০ টাকা হয়েছে।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৩৯টি ওষুধের দাম ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ কোম্পানির সেফ ৩ ক্যাপসুলের দাম ২৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৪৫ টাকা করা হয়েছে। এর আগের দাম ছিল ৩৫ টাকা। ট্রাইডিল ৫ ট্যাবলেট ২০ শতাংশ বেড়ে ১২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কনটিলেক্স টিএস ট্যাবলেট ২৫ শতাংশ দাম বেড়ে প্রতি পিস ২০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ৩৬টি ওষুধের দাম ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গ্লাইমিন ট্যাবলেট ৫০০ মিলিগ্রাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি পিস ৪ টাকা করা হয়েছে। ক্লোনট্রিল ০.০৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট ১৬ শতাংশ বেড়ে প্রতি পিস ৭ টাকা করা হয়েছে।
এদিকে, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ১৪টি ওষুধের দাম ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। ছয় টাকার এমডোক্যাল প্লাস ৫০ ট্যাবলেট ৪১ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি পিস ৮ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। টোফেন ট্যাবলেট ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ট্যাবলেট ৪ টাকা করা হয়েছে। ৩৮ টাকার ডিফ্লাক্স সাসপেনশন সিরাপ ৩১ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি বোতল ৫০ টাকা করা হয়েছে। তবে বাজারে এ দামের বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দোকানভেদে দামের হেরফের
রাজধানীর পাইকারি ওষুধের বাজার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দোকানভেদে দাম ভিন্ন। অনেক দোকানে ওষুধ আগের দামই রাখা হচ্ছে, কিছু দোকানে বাড়তি দাম রাখছেন বিক্রেতারা।
হাসপাতালসংলগ্ন ফার্মেসি মেডিসিন ভিউ। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট জিম্যাক্স-৫০০ পাইকারি ৪৩ টাকা আর খুচরায় ৪৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এই ওষুধের বর্তমান মূল্য ৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৩৫ টাকা। তবে উল্টো চিত্র পাশের মদিনা মেডিসিন কর্নারে। একই ওষুধ এখানে মিলছে ৩৮ টাকায়।
টোফেন সিরাপের বর্তমান দর ৭৫ টাকা। আগে ছিল ৭০ টাকা। কামাল ফার্মেসিতে এই সিরাপ ৭৫ টাকায় বিক্রি হলেও সাহিদা মেডিকেল স্টোরে নির্ধারিত দরের ২ টাকা কমে ৭৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই দর সিটি ফার্মাতেও। এই দোকানে বর্তমান নির্ধারিত দর থেকে দুই-তিন টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে অন্য ওষুধ।
সাহিদা মেডিকেল স্টোরে পিনাট ক্যাপসুল প্রতি পিস ৩ টাকা ৮০ পয়সাতে বিক্রি করছে তারা, যার বর্তমান দর ৫ টাকা। আগে ছিল প্রতি পিস ৪ টাকা। অ্যাটোভা ১০ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকায়, যার বর্তমান মূল্য ১২ টাকা। আগে ছিল ১০ টাকা। কামাল ফার্মেসি টিকালগ ট্যাবলেট বিক্রি হচ্ছে আগের দাম ৬৫ টাকায়। একই ওষুধ সাহিদা মেডিকেল স্টোরে বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়, যার বর্তমান দাম ৭৫ টাকা। এই ওষুধের আগের দাম ছিল ৬৫ টাকা।