বরিশাল প্রতিনিধিঃ- দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কালবৈশাখী ঝড়। এতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে অনেক গ্রাম। কালবৈশাখী ঝড়ে গাছচাপায় তিন জেলায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রোববার সকালে ও দুপুরে কালবৈশাখী ঝড়ে পিরোজপুরে দুজন, পটুয়াখালীতে দুজন, ভোলায় দুজন ও বাগেরহাটে একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, রোববার সকালে পিরোজপুরে হঠাৎ ১৫ মিনিটের কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পিরোজপুর পৌরসভা, পালপাড়া ও সদর উপজেলার শারিকতলা ডুমরিতলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। সদর উপজেলায় গাছচাপায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
সদর উপজেলার শারিকতলা ইউপির চেয়ারম্যান আজমীর মাঝি জানান, ঝড়ের তাণ্ডবে নলবুনিয়া গ্রামের খালে পড়ে মৃত কানাই লাল পালের ছেলে অনিল পাল (৮২) মারা গেছেন।
ওই চেয়ারম্যান আরও জানান, ঝড়ের সময় কানাই লাল গ্রামের একটি বাজারে ছিলেন। ঝড়ের গতি বাড়তে থাকায় এ সময় তিনি বাড়িতে রওনা দিলে প্রচণ্ড বাতাসে তিনি খালে পড়ে নিখোঁজ হন। ঝড় থামলে পরে স্থানীয়রা তাকে মৃত অবস্থায় খাল থেকে উদ্ধার করে। ঝড়ের সময় শারিকতলা ইউনিয়নের মরিচাল গ্রামে ঘরের ওপর গাছ চাপা পড়ে রুবী বেগম (২২) নামে এক মহিলা নিহত হন এবং তার এক শিশু কন্যা গুরুতর আহত হলে তাকে খুলনায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
স্থানীয়রা জানান, ঘূর্ণিঝড়ে পিরোজপুর পৌরসভা ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় শত শত গাছ উপরে পড়ে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাঁচা ঘরবাড়ির টিনের চালা উড়ে যায়, উপড়ে পড়ে বহু গাছপালা। বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। ঘূর্ণিঝড়ে গাছ উপড়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা রাস্তায় কাজ করছে।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান জানান, হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা উপড়ে পড়ে পিরোজপুরের সদর উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় ১ জন নিহত হয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
লালমোহন (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডবে তছনছ হয়ে গেছে ভোলার লালমোহন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত আড়াইশ ঘরবাড়ি। রোববার বেলা ১১টার দিকে লালমোহনে হঠাৎ করেই বইতে শুরু করে ঝড়। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলে ঝড়ের তাণ্ডব। এতে ঘর চাপা পড়ে ও বজ্রপাতে দুইজন নিহত হয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝড়ের প্রভাবে উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ঘর চাপা পড়ে হারিছ আহমেদ (৭০) নামে এক ভিক্ষুক নিহত হয়েছেন। তিনি পার্শ্ববর্তী ফরাজগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
অন্যদিকে বজ্রপাতে উপজেলার চরভূতা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চরলেঙুটিয়া গ্রামে মো. বাচ্চু নামে (৩৫) এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি ওই এলাকার কয়ছর আহমেদের ছেলে। এছাড়া ঝড়ে আড়াইশ ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত পঞ্চাশটি ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ঝড়ের তাণ্ডবে ছিঁড়ে গেছে বিদ্যুতের তার। কৃষি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা করা হচ্ছে।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ঝড়ে দুইজনের প্রাণহানিসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে বরাদ্দের জন্য জেলায় পাঠাব। বরাদ্দ পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের তা প্রদান করা হবে।
বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
পটুয়াখালীর বাউফলে কালবৈশাখী ঝড়ে রাতুল (১৪) নামের এক কিশোর ও সুফিয়া বেগম (৮৫) নামের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন।
রাতুলের বাড়ি উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের রায় তাঁতের কাঠি গ্রামে। বাবার নাম জহির সিকদার। তাকে রাস্তায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে বজ্রপাতে তিনি মারা গেছেন। আর সুফিয়া বেগমের বাড়ি উপজেলার দাশপাড়া ইউনিয়নের চরআলগী গ্রামে। তার স্বামীর নাম মৃত আহম্মেদ প্যাদা। ঘরের উপর গাছ চাপা পরে তিনি নিহত হন। এছাড়াও ঝড়ে উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থকে ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ৩৫ মিনিট স্থায়ী এ ঝড়ে কাঁচা বাড়ি-ঘর, গাছ গাছালি উপরে গেছে। বাউফলের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় শতাধিক আধপাকা বাড়ি বিধ্বস্ত ও কয়েক হাজার গাছগাছালি উপরে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় ব্যাপক শিলাবৃষ্টি ও বিরামহীনভাবে বজ্রপাত হয়েছে।
বাউফল পৌর শহরের থানার সামনে ছালেহিয়া ফাজিল মাদ্রাসার একটি ভবনের টিনের চালা উপড়ে রাস্তায় পরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গোসিংগা গ্রামের আফসেরের গ্রেজ এলাকায় ঘরের উপর গাছ ভেঙ্গে পড়ে মা সাবিহা (৩০), তার মেয়ে ইভা (১২) ও দুই বছর বয়সি শিশু মারাত্মক আহত হয়েছে। ঝড়ে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে ও বেশ কয়েকটি খুঁটি ভেঙে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে তরমুজসহ রবি ফসল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বশির গাজী বলেন, ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য কৃষি বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাট প্রতিনিধি: বাগেরহাটে রোববার সকাল ৯টার দিকে আকস্মিক ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে কয়েকশ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার-হাজার গাছপালা উপড়ে ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আকস্মিক ঝড় চলাকালে জেলার কচুয়া উপজেলার চর সোনাকুড় গ্রামে বজ্রপাতে লিকসান সরদার (৩২) নামে মাদ্রাসার দপ্তরি নিহত হয়েছেন।
এছাড়া জেলা কেন্দ্রীয় বাস-টার্মিনালে একটি সাইনবোর্ডের টাওয়ার ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যাত্রীবাহীবাসের উপর পড়ে এক বাস শ্রমিকসহ বিভিন্ন স্থানে ১৫ জন আহত হয়েছেন।
ঝড়ে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বাগেরহাট সদর উপজেলার গোবরদিয়া, বাদেকাড়াপাড়া, ডেমা, খারদার, বাসাবাটি গ্রামসহ পৌর এলাকা। এদিকে ঝড় শুরুতে সকালে জেলাজুড়ে দিনের বেলায় নেমে আসে রাত। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে বজ্রবৃষ্টি হলেও দিনের বেলায় এমন অন্ধকার আগে দেখেনি কেউ। প্রায় ২০ মিনিট অন্ধকারে ঢাকা থাকায় বন্ধ হয়ে যায় মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম। বাগেরহাট জেলা শহরসহ ৯ উপজেলার সবখানেই এমন অস্বাভাবিক দৃশ্য চোখে পড়ে সবার। এরপর বজ্রপাতের সাথে অবিরাম বৃষ্টিপাত শুরু হলে আকাশ পরিচ্ছন্ন হয়।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালিদ হোসেন জানান, আকস্মিক ঝড়ে বাগেরহাটের দেড় শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘরবাড়ি ও গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ঝড়ের মধ্যে গরু আনতে গিয়ে বজ্রপাতে কচুয়া উপজেলার চর সোনাকুড় আলিম মাদ্রাসার দপ্তরি লিকসান সরদার নিহত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারিভাবে ৩ মেট্রিক টন চাউল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে পড়ে রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে জেলা সদরসহ ৯টি উপজেলায় বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বিকালে জেলা সদরের কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ আসলেও অধিকাংশ এলাকায় সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি: ভোলার বিচ্ছিন্ন মনপুরা উপজেলায় হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে পুরো দ্বীপাঞ্চল। এতে উপজেলার হাজিরহাট, উত্তর সাকুচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার তিন শতাধিকের ওপরে ঘর-বাড়ি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত আধা ঘণ্টাব্যাপী কালবৈশাখী ঝড়ের পাশাপাশি বৃষ্টির তাণ্ডবে এ ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ঝড়ে বিধ্বস্ত ঘরের নিচে চাপা পড়ে তিনজন আহত হন। এদের সবাইকে মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। তারা হলেন- শাকিল, ফরিদ ও ইব্রাহীম। এদের সবার বাড়ি হাজিরহাট ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে পূর্ব সোনারচর গ্রামে।
এছাড়াও অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি উপজেলার মনোয়ারা বেগম মহিলা কলেজের টিনশেড ক্লাসরুমটি বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ে গাছপালা পড়ে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। অনেকের মাছের ট্রলার ও নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন চরে থাকা কৃষকের ৩০টি গরু নদীতে পড়ে নিখোঁজ রয়েছে।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এমপি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে এক লাখ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছেন বলে যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ও হাজিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন হাওলাদার।
উপজেলার ২নং হাজিরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগ সভাপতি নিজাম উদ্দিন হাওলাদার জানান, হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে হাজিরহাট ইউনিয়নে দুই থেকে আড়াইশ ঘরের ওপরে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। চর থেকে কৃষকের ৩০টি গরু নদীতে পড়ে হারিয়ে যায়। এমপি তাৎক্ষণিক এক লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম জানান, কালবৈশাখী ঝড়ে আড়াইশ থেতে তিনশ ঘর সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মাঠে ক্ষয়-ক্ষতির নিরূপণ করা হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। কোনো সাহায্য সহযোগিতা পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে দেওয়া হবে।