তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার লায়নর,কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি ঃ
জয়পুরহাটের কালাইয়ে চলতি মৌসুমে কৃষকেরা জমিতে রোপাআমন ধান
রোপন করেছেন। প্রাকৃতিক ভাবে তেমন কোন দুর্যোগ না হওয়ায় এবং
আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার উপজেলায় ১১হাজার ৯শ ৫০হেক্টর জমিতে
যথাসময়ে রোপাআমন ধানের চারা রোপন করেছেন। ঐসব জমিতে
রোপনকৃত চারাগুলো বড় হয়ে এখন ধান পাকতে শুরু করেছে এবং বাম্পার
ফলনও হয়েছে। উপজেলার কৃষি অফিস আয়োজনে এলাকায় কৃষকদের মধ্যে
পাচির্ং পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক পার্চিং
পদ্ধতির ব্যবহারের ফলে একদিকে কৃষকেরা কীটনাশক ছাড়াই পোকার আক্রমণ
থেকে ধানগাছ রক্ষা পাচ্ছেন, তেমনি আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন তারা,
অন্যদিকে কৃষকের কীটনাশক প্রয়োগরে পরিশ্রম অনেক কমেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, এ উপজেলায় এবার বোরো ধান ক্ষেতে পোকা
দমনে কীটনাশকের পরিবর্তে পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে। উপজেলার
কৃষকরা ক্ষতিকর কীটনাশকের পরিবর্তে ক্ষেতে পার্চিং পদ্ধতির ব্যবহারে
বেশি সচেতন তারা এখন। কৃষকেরা তাদের ফসলি জমিতে মাজরা পোকা,
পাতা মোড়ানো পোকা, খাটসুর, ঘাসফড়িং ও পাতাফড়িং, কারেন্ট
পোকাসহ নানা ধরণের ক্ষতিকারক পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পার্চিং
পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এ পার্চিং পদ্ধতি হচ্ছে পাখির মাধ্যমে ফসলের
পোকা দমনে ভালো ব্যবস্থা। কৃষকরা তাদের রোপাআমন ফসলের ক্ষেতের মধ্যে
১০ থেকে ১২হাত দূরে দূরে বাঁশের আগা, বাঁশের কঞ্চি ও গাছের ডাল এবং
ধইঞ্চা পুঁতে দিচ্ছেন। ঐসব বাঁশের আগা, বাঁশের কঞ্চি ও ধইঞ্চার ডালে
উড়ে এসে বসে শালিক, ফিঙে, বক, বুলবুলিসহ নানা জাতের পাখি।
সেখানে কিছুক্ষণ পরপর বিভিন্ন ধরনের পোকাখাদক পাখি ধানগাছের
মধ্যে ঢুকে ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফেলছে এবং পরে ওইসব পাখি পার্চিংয়ে
বসে ক্ষণিক সময়ের বিশ্রামও নিচ্ছে। এপার্চিং পদ্ধতিতে কীটনাশক
ছাড়াই পোকার আক্রমণ থেকে ধানগাছ রক্ষা পাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক
ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি কম খরচে বেশি লাভ হচ্ছেন উপজেলার কৃষকরা।
কালাই উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কালাই পৌরসভাসহ
উপজেলার মাত্রাই, উদয়পুর, পুনট, জিন্দারপুর ও আহম্মেদাবাদ ওই ৫টি
ইউনিয়নে এবার চলতি রোপাআমন মৌসুমে ১১হাজার ৯শ ৫০হেক্টর
জমিতে বোরো ধান রোপন হয়েছে। এর মধ্যে উপজেলায় হাইব্রিড জাতের
ধান রোপন হয়েছে ৮শ ৫০ হেক্টর জমিতে এবং উফশী জাতের ধান হয়েছে
১১হাজার ১শ হেক্টর জমিতে। এ উপজেলায় কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই
প্রাকৃতিক উপায়ে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রোপাআমন ফসল রক্ষায়
পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কৃষকরা। এ পার্চিং দুই প্রকার-একটি
ডেড পার্চিং আর অন্যটি লাইভ পার্চিং। বাঁশের আগা, বাঁশের কঞ্চি ও
মরা গাছের ডাল পুঁতে দিলে তা হবে ডেড পার্চিং এবং ধঞ্চে, কলাগাছ
ইত্যাদি জীবন্ত পুঁতে দিলে তা হবে লাইভ পার্চিং। ধানখেতে পার্চিং
পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে কীটনাশকের অযাচিত ব্যবহার কমছে, সেই সঙ্গে
ফসলের উৎপাদন বাড়ছে।
উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নে নওয়ানা গ্রামের কৃষক মো. ছামছুন বলেন,
এবার ৬ বিঘা জমিতে উফশী জাতের ধান রোপন করেছি। ধানের ক্ষতিকর
পোকা দমনে বিশেষ করে মাজরা পোকা দমনে নির্দিষ্ট ব্যবধানে বাঁশের
কঞ্চি ও ধইঞ্চার পুঁতে রেখেছি। এতে খুব উপকার পাচ্ছেন এবং ধানও ভালো
ফরন হয়েছে। এসব কঞ্চিতে ফিঙে বসছে। আর পাখিগুলো ক্ষতিকর
পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। খেতে তেমন কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি।
সেখানে বহুতী গ্রামের আরেক কৃষক মো.আনিসুর বলেন, গতকয়েক বছর
আগে আমাদের এই মাঠের ধানে জমিতে অনেক পোকায় আক্রমণ করত।
পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার করেও তেমন কাজ হতোনা। এরপর কালাই
কৃষি অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে পার্চিং পদ্ধতি ব্যবহার করায়
এখন সুফল পাচ্ছি।
উপজেলার মাত্রাই গ্রামের কৃষক মো.জাহাঙ্গির বলেন, ধানের চারা রোপণের
পর পর বাঁশের আগা, ধইঞ্চা ও গাছের ডাল প্রভৃতি পুঁতে রাখলে জমিতে
ক্ষতিকর পোকা দমন করা যায়। এপার্চিং পদ্ধতিতে ধান চাষ করে লাভবান
হচ্ছি। আমার মতো অনেকেই এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন। এলাকায় খুবই
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পার্চিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ। এতে কীটনাশক কম
লাগার ফলে ফলন ভালো হয়েছে।
কালাই উপজেলার কৃষি অফিসের উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষন অফিসার
মো. ছালজারুল আলম বলেন, এপার্চিং পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকা বিশেষ করে
মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, খাটসুর, ঘাসফড়িং ও পাতাফড়িং
দমনে পার্চিং পদ্ধতি খুব কার্যকর। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব। পোকা দমনে
কীটনাশক না দেওয়ায় এতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও কম হয়। ধানের ফলনও বেশি
হয়। এর পাশাপাশি কৃষকেরা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হচ্ছেন।
এই বিষয়ে কালাই উপজেলার কৃষি অফিসার কৃষিবিদ অরুণ চন্দ্র রায়
বলেন, এ উপজেলার অনেক কৃষকেরা ধানক্ষেতে পোকা দমনের জন্য ক্ষতিকর
কীটনাশক ব্যবহার করে। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে শত্রু পোকা
নিধনের সঙ্গে বন্ধু পোকাও মারা যায়। ক্ষতিকর পোকা দমনে পার্চিং পদ্ধতি
খুব কার্যকর। এই পদ্ধতি কাজে লাগালে কীটনাশকের ব্যবহার কমে যায়।
সেইসঙ্গে কৃষকেরা উৎপাদন খরচও কম হয়। বালাইনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব
থেকে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা যায়। উপজেলায় এই বছর শতভাগ জমি
পার্চিংয়ের আওতায় এসেছে।