কুড়িগ্রামে দেখা মিলেছে রুপকথার আদু মিয়ার/ দুলু মিয়া একই ক্লাসে আছেন ২৫ বছর !
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামে রুপকথার গল্পের সেই আদু মিয়া খ্যাত মোঃ দুলু মিয়া (৩৫) নামের এক যুবকের দেখা মিলেছে।তার বাবার নাম মৃত মালু মিয়া।তিনি ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের দিয়াডাঙা গ্রামের বাসিন্দা।তবে আদু মিয়া খ্যাত এই দুলু মিয়া থাকেন ভুরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ই উনিয়নের তালুক মশাল গ্রামের একটি কবরস্থানে। অন্যের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করলেও গাছপালা বেষ্টিত কবর স্থানই তার পছন্দের জায়গা। সেখানে ঘুমান,দিন হলে পড়াশোনা করতে ছুটেন প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে।
জানা গেছে, দুলু মিয়ার মা মারা যাওয়ার পর ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কবরস্থানে।মাঝে মধ্যে স্বজনা তাকে বাসায় নিয়ে গেলেও কবরস্থানে নিজের হাতে তৈরি কাঠের বাক্স,একটি বালিশ আর বেড়াবিহীন টিনের চাল তার খুবই পছন্দ।পড়াশোনা ভালো আগ্রহ।হাতের লেখাও ভালো।তবে পড়াশোনায় উন্নতি নেই তার।দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে পড়ে আছেন দুলু মিয়া। বয়স ৩৫ বছর হলেও এখনো প্রাথমিকের গন্ডি পার করতে না পারা দুলু মিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন।বছরের পর বছর লেখাপড়া করতে ছুটে চলেন বিদ্যালয়ে।তবে এক স্কুলে পড়াশোনা করে মন ভরে না তার। এলাকা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তি কিংবা দূরে ৩-৪ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনিবন্ধিত ছাত্র তিনি। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সব কটি স্কুলে একই (দ্বিতীয়)শ্রেনীতে পড়েন তিনি। তবে দুলু মিয়াকে নিয়ে নানান ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।তার বাবা মা স্বজন নেই বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের ভিউ বাড়ানোর জন্য যে প্রচারণা চালিয়ে ছিল তা ছিল অনেকটা মানুষদের বোকা বানানো।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুলু মিয়ার মা বাবা দু'জনই ছিলেন।মারাও গেছেন।দুলু মিয়া দুই ভাই দু-বোন ।দিয়াডাঙা গ্রামে ছিল তার স্থায়ী বাস। বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃ ক সম্পদ বলতে ছিল শুধু ৪ বিঘা জমি আর বসতবাড়ি। বর্তমানে সেখানে বসবাস করেন তার ছোট ভাই বেলাল মিয়া। দুবোনের বিয়ে হয়েছে।দুলু মিয়া বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধী হওয়ায় বাবা মারা যাওয়ার আগেই জমি লিখে নিয়েছেন বড় ভাই।মা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ তিনি ঘর ছা ড়া হন।আশ্রয় নেন তালুক মসাল পাড়া গ্রামের রঞ্জু মিয়ার পারিবারিক একটি কবরস্থানের জঙ্গলের ভিতর।ঝড়,বৃষ্টি, শীত গরমে ওই কবরস্থানে আলোবিহীন জঙ্গলে বসবাস করেন তিনি।তার সম্বল বলতে নিজের তৈরি বেড়াবিহীন চার টিনের চাল,স্কুলে যাওয়ার জন্য নিজের তৈরি ছোট তিন চাকার গাড়ি ও একটি কাঠের বাক্স।ওই বাক্সে কাপড় চোপড়,বই খাতা কলম তালাবদ্ধ করে রেখে বাক্সের উপরে ঘুমান।স্কুলে যাওয়ার জন্য নিজেই তৈরি করেছেন টায়ারবিহীন ভ্যান আকৃতির প্রাইভেট গাড়ি।অনেকের কাছে তার জীবন যাপন কষ্টকর মনে হলেও কেউ কেউ দুলু মিয়াকে সুখি মানুষ হিসেবে জানেন।কেউ খেতে দিলে খান।খাবার না পেলে কবরস্থানেই ঘুমান।তবে প্রায় সময় স্থানীয় মোঃ রঞ্জু মিয়া ও আশরাফুল ইসলাম নামের দুই ব্যাক্তির বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে চলছে তার জীবন।দুলু মিয়ার একটাই কাজ বিদ্যালয়ে ছুটে চলা।নিজের তৈরি সাইকেল নিয়ে বছরের পর বছর লেখাপড়া করতে ছুটে যান স্কুলে।তার রুটিনে সরকারি ছুটি কিংবা বন্ধের দিন বলতে কোন শব্দ নেই।
প্রতিবন্ধী হলেও তার বিরুদ্ধে সহপাঠী, শিক্ষক অভিভাবকসক কারো অভিযোগ নেই। শান্ত শিষ্ট দুলু মিয়া দ্বিতীয় শ্রেনিতে বছরের পর বছর পড়ে আসছেন।সহপাঠীরা তাকে ছেড়ে উচ্চ মাধ্যমিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বড় কর্মকর্তা হলেও দুলু মিয়া পড়ে আছেন একই ক্লাসে।শিক্ষা জীবনের প্রায় ২৫ বছর পার করলেও এক ই ক্লাসে থাকার বিরল ঘটনায় হতবাক মানুষজন।কেউ বলছেন এক সময় স্কুলের বিস্কুট খাওয়ার লোভে দুলু মিয়ার স্কুল যাওয়া শুরু করে এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তালুক মসাল পাড়া গ্রামের মোঃ রঞ্জু মিয়া বলেন,আমি জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি দুলু মিয়ার মত এমন মানুষ দেখি নাই।কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না।দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে আছে। তার সহপাঠীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি ব্যবসা বানিজ্য করছে।আর দুলু মিয়া পড়ে আছে একই ক্লাসে।সে প্রতিদিনই নিজের বানানো দুই চাকার ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যায়।স্কুল খোলা কিংবা বন্ধের দিন বলতে তার কাছে কিছু নেই।প্রতিদিনই স্কুল যান তিনি।
স্থানীয় শিক্ষার্থী মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন,আমি এবারে এস এস সি পরিক্ষায় পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।সে আমার ক্লাসের সহপাঠি ছিলেন।আমার বড় ভাইকেও দেখেছি দুলু ভাইয়ের সাথে একই ক্লাসে পড়তে।এখন ছোট ভাইদের সাথে সে পড়েতেছে। আমরা পড়াশোনা করে মাধ্যমিক শেষ করলাম অথচ উনি এখনো প্রাইমারিতে আছেন।স্কুলে সবার আগে যেতেন দুলু ভাই। প্রায় দিনই ক্লাস রুমের বারান্দা পরিস্কার করতেন।কেউ তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখি না।তিনি একজন ভালো মানুষ।
দুলুর ভাই বেলাল মিয়া বলেন,দুলু ভাই কানে কম শুনে।তার বুদ্ধি কম তবে ছোট কাল থেকে পড়াশোনা করার আগ্রহ খুব বেশি।সে বাড়িতে না থেকে কবর স্থানে থাকে।আমরা কি করবো।তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে হয়তো ভালো হতে পারতো।
দিয়াডাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছাঃ হালিমা খাতুন বলেন,দুলু মিয়া সময়মত স্কুলে আসতো।স্কুলের বারান্দায় ময়লা, খড়কুটো দেখলে অফিস রুমে ঢুকে ঝাড়ু নিয়ে সেগুলো পরিস্কার করতো। নিজেকে খুব পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে সে।ব্রেঞ্চ কিংবা মাঠে কোন ময়লা থাকলে সে পরিস্কার করতো।কানে একদম কম শুনে।তবে লিখতে পারে কোন কিছু বলতে পারে না।
তিনি আরো বলেন,দুলু মিয়া স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম নেই।তবে অনেক বছর ধরে একই (দ্বিতীয়) শ্রেনির বই নিয়ে স্কুল যাওয়া আসা করতেছে।ছেলে মেয়েদের কারো সাথে কোন খারাপ আচরণ করে না।প্রায় ২৫ বছর ধরে একই ক্লাসে পড়ে আছে দুলু।
পাথরডুবি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুস সবুর বলেন, আমার ইউনিয়নের ৪ নং তালুক মসাল পাড়া গ্রামে থাকেন দুলু মিয়া। সে প্রতিদিনই স্কুলে যায়। তার নামে প্রতিবন্ধি ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা পেলে তার বসবাসের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবো/।