কুড়িগ্রামে বাড়ছে প্রতিবন্ধি জনগোষ্টির সংখ্যা
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ দেশের দারিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রামে বাড়ছে প্রতিবন্ধি জনগোষ্টির সংখ্যা। প্রতিবন্ধির হার কমিয়ে আনতে পুষ্টিকর খাবার,বাল্য বিয়ে বন্ধ, গর্ভবতি নারীদের চিকিৎসা নিশ্চিতসহ সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন বিশেষজ্ঞগণ।
অটিজম বা প্রতিবন্ধী জনগোষ্টির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে দেশের দারিদ্যপীড়িত খ্যাত জেলা কুড়িগ্রামে। দারিদ্রতা, পুষ্টিহীনতা, কুসংস্কারসহ সচেতনতার অভাবে ক্রমেই বেড়ে চলেছে প্রতিবন্ধি জনগোষ্ঠির সংখ্যা। প্রতিবন্ধি সন্তানদের নিয়ে নিম্ন আয়ের এসব পরিবারের দিন কাটছে ভোগান্তিতে। সরকারি সহায়তা পেলেও দারিদ্রতার কারণে সঠিক দেখভালের অভাব থেকে যায়। প্রতিবন্ধি পরিবারের বোঝা নয় এমন কথা বলা হলেও ভিন্ন চিত্র বিরাজ করছে কুড়িগ্রামে। সরকারি-বেসরকারি ভাবে প্রতিবন্ধিদের সামাজিক ভাবে প্রতিষ্টিত করতে কাজ করলেও কমছে না প্রতিবন্ধির সংখ্যা। প্রতিবন্ধি মানুষের সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দারিদ্রপীড়িত জেলায় বাল্য বিয়ের ফলে অল্প বয়সে গর্ভ ধারণ,পুষ্টিহীনতা,গর্ভবতি মায়েদের সময় মতো সঠিক চিকিৎসাসহ সচেতনতার অভাব এবং সামাজিক কুসংস্কার কে দায়ী করছেন অনেকেই। কর্মসংস্থানের অভাব আর দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতির কারণে নিম্ন আয়ের পরিবার গুলোর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে।
কুড়িগ্রাম পৌরসভার পুরতান হাসপাতাল পাড়ার বাসিন্দা মৃত জলিলের ছেলে ২১বছর বয়সি শান্ত। জন্ম থেকে দৃষ্টি ও শারিরিক প্রতিবন্ধি। শান্তর বাবা-মাসহ ভাই বোন কেউ নেই। ছোট থেকে চাচী বিউটি বেগমের নিকট থেকে বড় হচ্ছে। চিকিৎসাসহ ভরণ পোষণ শান্তর চাচী করেন।
ধরলা নদীর টি-বাঁধে বসবাসকৃত মোসলেমা বেগম প্রায় ১৮বছর আগে বিয়ে হয় মাত্র ১৩বছর বয়সে। এরমধ্যে তিন সন্তানের মা হয়েছেন তিনি। তার বড় ছেলে ১৯বছর বয়সী শিহাব। চলাচল করতে পারলেও একটি হাত পুঙ্গ,কথা কিছুটা অস্পষ্ট। মোসলেমা বেগমের অল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণ এবং দারিদ্রতার কারণে গর্ভবতিকালীন সময় জোটেনি কোন পুষ্টিকর খাবার এবং সঠিক চিকিৎসা। দু সন্তান স্বাভাবিক হলেও শিহাবের বেলা ঘটেছে ব্যতিক্রম ঘটনা। এমন অসংখ্য প্রতিবন্ধি শিশুদের মায়ের দু:খ-কষ্টের কথা প্রায় একই। ফলে একদিকে দারিদ্রতা অপর দিকে প্রতিবন্ধি সন্তান নিয়ে অসহনীয় দু:খ-কষ্টে কাটছে তাদের জীবন।
বিউটি বেগম বলেন,শান্ত ছোট থাকতেই ওর বাবা.চাচারা মারা গেছেন। ওর মা নিজেও পাগলি হওয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ছোট থেকে শান্তকে দেখভাল করে আসছি। শান্তর দু’চোখে কম দেখে,জ্ঞান বুদ্ধি কম,মৃগি রোগও আছে। প্রতিমাসে সাড়ে আট করে প্রতিবন্ধি পায় শান্ত।
মোসলেমা বেগম বলেন,দারিদ্রতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর পর সন্তান নেই। গরিব মানুষ পুষ্টিকর খাবার তো চিন্তা করাই যায় না। যখন যা জোটে তাতেই পেট বাঁচাতে খেতে হয়। আর ডাক্তার দেখানোর সুযোগ কই?
একই এলাকার বাসিন্দা রশিদা বেগম বলেন,জমি জমা নেই এই বাঁধের জায়গাতেই পড়ি আছি পরিবার নিয়ে। আমার মেয়ে মনি আকতার যখন পেটে ছিল তখন আমি বিড়ি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেছি। মেয়েটা জন্মের পর ওকে নিয়ে বিড়ির কাজ করতে যাই। মাটিতে শুয়ে রেখে,কখনও আবার কোলে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এভাবে খাওয়ার ত্রুটি আর কিছু অনিয়মের কারণে মেয়েটার পুষ্টির অভাব হয়। ফলে হাটতে পারে না। সেজন্য অনেক চিকিৎসা করেছি। মাটিতে গর্ত করে দাঁড় করিয়েছি,বাঁশের খুটি, গাড়ির টায়ারের সাথে বেঁধে হাটানো চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন ভাবে সুস্থ হয়নি। এখন একটু কষ্ট করে হাটতে পারলেও মানসিক প্রতিবন্ধি হয়েছে। গরিব মানুষ হামরা পেটে ভাত দেবার চিন্তা করি না মেয়ের বড় ডাক্তারের চিকিৎসার কথা চিন্তা করাটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না হামার।
পুরাতান হাসপাতাল পাড়ার বাসিন্দা আলো বিবি বলেন,প্রায় বিশ বছর ধরে দু’কানে শুনতে পাই না। কানে না মুনতে না পাওয়ায় মানুষ টসা,কালা ইত্যাদি বলে খ্যাপায়। শুনতে খারাপ লাগলেও এখন সয়ে গেছে। আমার বাড়িতে আরও দু’জন প্রতিবন্ধি রয়েছে। একজন কানে কম শোনে আর একজন মানসিক প্রতিবন্ধি। সরকারি ভাতা পেতে আবেদন করেছি।
কুড়িগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়,জেলার ৯টি উপজেলার ৭৩টি ইউনিয়ন এবং ৩টি পৌরসভার মধ্যে প্রতিবন্ধি সনাক্ত হয়েছে ৬৭হাজার ৪২৭জন এবং এরমধ্যে ভাতা সুবিধা পাচ্ছেন ৪৯হাজার ৫৬৯জন প্রতিবন্ধি। সরকারি ভাবে প্রতিমাসে ৮৫০টাকা করে প্রতিবন্ধি ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
তথ্যানুযায়ী দেখাযায়,২০১৫সালে ২৯হাজার ৭৫৬জনের মধ্যে ভাতা ভোগী-১৩হাজার ৭৪৭জন, ২০১৬সালে ৩০হাজার ৪২৫জনের মধ্যে ১৬হাজার ৪৮৮জন, ২০১৭সালে ৩০হাজার ৮০৫জনের মধ্যে ১৮হাজার ৩৪৩জন, ২০১৮সালে ৩১হাজার ৫৪১জনের মধ্যে ১৯হাজার ১২৫জন, ২০১৯সালে ৩২হাজার ৬৮৪জনের মধ্যে ২১হাজার ৬২৩জন, ২০২০সালে ৪০হাজার ৮৪০ জনের মধ্যে ৩১হাজার ২০১জন, ২০২১সালে ৪৮হাজার ৩৭জনের মধ্যে ৩৩হাজার ৩৭৫জন, ২০২২সালে ৬৪হাজার ১৫৭জনের মধ্যে ৩৯হাজার ৭৩৪জন এবং ২০২৩সালে ৬৭হাজার ৪২৭জনের মধ্যে ৪৯হাজার ৫৬৯জন প্রতিবন্ধি জনগোষ্ঠি সনাক্ত এবং ভাতা প্রাপ্ত হন।
কুড়িগ্রাম প্রতিবন্ধি সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের কনসালটেন্ট ডা: আরিফুর রহমান বলেন,পর্যায়ক্রমে কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে বলেন,জেলায় অটিজম,শারিরিক,মানসিক অসুস্থজনিত প্রতিবন্ধি,দৃষ্টি,বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ প্রতিবন্ধির সংখ্যা বেশি। আর এসব প্রতিবন্ধি বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বাল্যবিয়ে, পুষ্টিহীনতাসহ কুসংস্কারকেই দায়ী করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন, কুড়িগ্রামে প্রতিবন্ধি জনগোষ্টি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে জন্মগত ভাবে এবং জন্মের পরে বাল্যবিয়ে, পুষ্টিহীনতা, সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণকে দায়ী করেন তিনি। তবে সরকারি-বেসরকারি ভাবে প্রতিবন্ধি জনগোষ্ঠির সংখ্যা কমিয়ে আনা এবং প্রতিবন্ধিদের অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।#