ড্রাগন বিদেশি ফল হলেও বাণিজ্যিকভাবে এখন দেশে এই ফলের প্রচুর চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য ফলের পাশাপাশি ভোক্তাপর্যায়ে জনপ্রিয়তা বাড়ায় দেশের নানা প্রান্তে ড্রাগন চাষে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে কয়েক বছরে স্থানীয়ভাবে ড্রাগন উৎপাদন বেড়েছে। এতে করে ভোক্তাপর্যায়ে সুলভমূল্যে বিক্রি হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলেও বাজারে এই ফল চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে আড়তদারদের কারসাজির কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ড্রাগনচাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে কয়েক বছরে ড্রাগন চাষ ও উৎপাদন প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেড়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৯৫ হেক্টর জমিতে ৮ হাজার ৬৫৯ টন ড্রাগন উৎপাদন হয়েছে। পরের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২১-২২-এ ১ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয়েছে ১৩ হাজার ৮৭২ টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জমিতে হয়েছে ৫১ হাজার ২৮৭ টন।
ড্রাগনচাষিরা বলছেন, তাদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে ড্রাগন ফল কিনে আড়তদারদের সিন্ডিকেট অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছে। যার প্রভাবে খুচরা বাজারে দু-তিন গুণ বেশি দামে এই ফল কিনছেন ক্রেতারা।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিন গ্রেডে মাঠপর্যায়ে ৫০ থেকে ১৫০ টাকায় প্রতি কেজি ড্রাগন বিক্রি করেন তারা, যা বাজারে এসে ১০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু আড়তদাররা সেই ড্রাগন দ্বিগুণ পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করায় খুচরা বাজারে সর্বনিম্ন ২২০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা দাম পড়ছে। তা ছাড়া, একই সিন্ডিকেটের জন্য মাঠ থেকে ড্রাগন ফল সংগ্রহ করে শ্রমিক, ক্যারিং ও পরিবহন খরচ দিয়ে আড়তে এনেও তারা ভালো দাম পাচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড্রাগন ফলে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম, ওমেগা- ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, বিটা-ক্যারোটিন ও লাইকোপেনের মতো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি রয়েছে। ফলে ড্রাগন মানুষের কাছে প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হর্টি কালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল ফাইয়াজ মো. জামাল উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশের অন্যান্য ফলের পাশাপাশি ড্রাগনের চাহিদা বেড়েছে প্রচুর। কিন্তু গত বছরের গ্রোথ হরমোন ব্যবহারের ফলে বাজারে এই ফলের চাহিদা কমেছে। এতে করে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু চাহিদা বাড়ার কারণে দেশে এখন পর্যাপ্ত ড্রাগনের চাষ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, একটা সময় থাইল্যান্ড থেকে ড্রাগন আমদানি হলেও বর্তমানে দেশে উৎপাদিত ফলটির বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। এর জন্য অন্যান্য ফলের পাশাপাশি ড্রাগন বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে এ, বি ও সি গ্রেডের ড্রাগন ফল পাওয়া যায়। গ্রেড অনুযায়ী আলাদা আলাদা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। এর মধ্যে ৩ থেকে ৪টি এক কেজি হলে তাকে এ গ্রেড ধরা হয়, ৫-৬টিতে কেজি হলে বি গ্রেড এবং ৮ থেকে ১০টিতে কেজি হলে ধরা হয় সি গ্রেড।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি এ গ্রেডের ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকা, বি গ্রেডের ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা ও সি গ্রেডের ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৫০ টাকায়।
বগুড়ার ড্রাগনচাষি আবিদ জামাল বলেন, মাঠপর্যায় থেকে প্রতি কেজি ড্রাগন গড়ে ৫০ থেকে ১৫০ কেনেন আড়তদারদের প্রতিনিধিরা। কিন্তু খুচরা বাজারে দেখা যায়, দাম তার দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি। ভোক্তারা বেশি দামে কিনলেও তারা আসলে দাম কমই পাচ্ছেন।
তিনি জানান, কোনো চাষি মাঠ থেকে ড্রাগন ফল তুলে আনুষঙ্গিক খরচ বহন করে আড়তগুলোয় নিয়ে গেলে তারা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করেন।
আবিদ জামাল বলেন, ‘আড়তদাররা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন, তাদের জন্য আমরা চাষিরা যেমন একদিকে আমাদের ফলানো ফলের সঠিক মূল্য পাচ্ছি না। অন্যদিকে এই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা কৃষকের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। এই দামে বিক্রি না করলে আমাদের অধিকাংশ ফসল মাঠে নষ্ট হয়ে যায়। এর জন্য আড়তপদ্ধতির বিকল্প বাজার করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।’
আরেক ড্রাগনচাষি মানিকগঞ্জের সপ্তর্ষি রায় জানান, আড়তদারদের নির্ধারিত দামে বাজারে ফল বিক্রি না করলে সেই ফল নষ্ট করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ড্রাগন চাষ ব্যয়বহুল হলেও বাজারে এর পর্যাপ্ত দাম পাওয়া যায় না। অথচ আড়তদাররা তাদের কাছ থেকে কম দামে ফল কিনে ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করেন। এতে করে ভোক্তাকেও বেশি দামে কিনতে হয়।
জানতে চাইলে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদি মাসুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি, যাতে করে ড্রাগন ফলের দাম ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। সর্বোচ্চ ১০০ টাকা হতে পরে এক কেজি ড্রাগন ফলের দাম। কিন্তু বাজারে যারা দাম বাড়াচ্ছেন, তারা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন।’
কোন ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছেন, তা দেখার জন্য কৃষি বিপণনের বাজার তদারকি টিম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ করছেন।’