নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে বিএনপি। এতে একচুলও ছাড় দিতে নারাজ দলটির নেতারা। এমনকি ইস্যুবিহীন কোনো সংলাপেও সাড়া দেবে না। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সরকার তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেবে বলে মনে হচ্ছে না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে শেষপর্যন্ত চেষ্টা চালাবে তারা।
তাই দাবি আদায়ে রাজপথে আন্দোলনের বিকল্প নেই। সমমনা দলসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সেই প্রস্তুতিই নেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই ঘোষণা করা হবে সরকার পতনের একদফা। রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের ওপর নানামুখী চাপ তৈরিতে জোরদার করা হবে কূটনৈতিক তৎপরতাও।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, এ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়। নানা চাপে পড়ে তারা হয়তো সুষ্ঠু ভোটের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু এদের বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই।
অতীতে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা রক্ষা করেনি। এবারও হয়তো নতুন কোনো ফন্দি রয়েছে। কিন্তু আমরা সেই ফাঁদে পা দেব না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হতে হবে আগামী নির্বাচন। তবেই সেই ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনি ধারা নিশ্চিতে আমরা রাজপথে আন্দোলন করছি। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে এ আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে।
আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বত্র আলোচনা চলছে। বিশেষ করে এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করায় তা নতুনমাত্রা পায়। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু সেরকম একটা নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা এখনো সুরাহা হয়নি। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ অনেকেই মনে করছেন, বিদেশি চাপ এবং সরকারের আশ্বাসে আওয়ামী লীগের অধীনেই হবে সেই নির্বাচন। শেষপর্যন্ত বিএনপিসহ সব দল তাতে অংশ নেবে।
তবে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই জেনেশুনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া হবে অনেকটা আত্মহত্যার শামিল। তাছাড়া দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরাও এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যেতে মত দিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন ভিসানীতি সরকারের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ নির্র্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই কিছুটা আতঙ্কে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
কেউ কেউ বলছেন, সরকার চাইলেও এবার যেনতেন নির্বাচন করতে পারবে না। তাই সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে। তবে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যেতে অনড় বিএনপির হাইকমান্ড। তাদের মতে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত থাকবেন তাদের প্রায় সবাই সরকারের আজ্ঞাবহ। আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে তারা নিজ উদ্যোগে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবেন।
বাইরে নির্বাচনি পরিবেশ সুষ্ঠু রাখবে যাতে বিদেশিরা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারেন। মার্কিন ভিসানীতির কারণে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্ট আতঙ্ক বা উদ্বেগ কাটাতে সরকার চেষ্টা চালাবে। নির্বাচনের আরও কয়েক মাস বাকি। এরমধ্যে সরকার চাপ সামলিয়ে উঠতে সবকিছুই করবে। তাছাড়া মার্কিন ভিসানীতির ভয়ে নির্বাচনে সবাই নিরপেক্ষ আচরণ করবে সেটা ভাবার কারণ নেই। এসব পর্যালোচনা করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে হাইকমান্ড।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু ভোটের কথা শুনলে সবাই হাসে। অতীতে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় তাদের বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। তাই এ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প নেই। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে বিএনপি সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে। গণতান্ত্রিক এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে।
তিনি বলেন, মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে সরকার বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার পতনের আন্দোলনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে। সহিংসতার মাধ্যমে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। এ কারণে তারা মার্কিন ভিসানীতির চাপে পড়বে। কিন্তু কি কি করলে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে সেটার ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কাজের মধ্যে রয়েছে-ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো, জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার চর্চাকে সহিংসতার মাধ্যমে বাধাদান। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
কিন্ত বিএনপি এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত নয়। ভোট বাধাগ্রস্ত করতে নয় বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতেই বিএনপির চলমান আন্দোলন। তাই এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথের আন্দোলন জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর পাশাপাশি সমমনা দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছে দলটির হাইকমান্ড। শিগগিরই সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলটি মনে করে, বিদেশি চাপের পাশাপাশি রাজপথে জোরদার আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারলেই শুধু সরকারের টনক নড়বে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ মুখে যাই বলুক, ক্ষমতায় থাকতে তাদের নতুন কোনো পরিকল্পনা রয়েছেই।
তাই এবার আমরা ফের ভুল করতে চাই না। তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি কিংবা কোনো আশ্বাসে আমাদের নজর নেই। বিএনপির মূল লক্ষ্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়। সেই লক্ষ্যেই আমরা চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করছি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শিগগিরই আমরা রাজপথে নামছি।