পাটের বাজারে ধস,লোকসানে চাষিরা
মনসুর আলম খোকন,সাঁথিয়া (পাবনা): গত বছরগুলোর তুলনায় এবার পাট চাষে এমনিতেই কৃষকের খরচ বেড়েছে। এরই মধ্যে মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মণ প্রতি পাটের দাম কমেছে ছয় থেকে সাত শ' টাকা। এতে চরম লোকসানে পড়েছেন চাষিরা।
উপজেলা কৃষি কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার সাঁথিয়া উপজেলায় সাত হাজার ৮৪৫ হেক্টর ও বেড়া উপজেলায় তিন হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে।দুই উপজেলার একাধিক চাষিদের সাথে কথা হলে তারা জানান,গত বছরে এই সময়ে প্রতিমণ পাট দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করা গেছে। এতে চাষিরা প্রতি মণে আট শ' টাকারও বেশি লাভ পেয়েছিলেন।গত বছর ভালো লাভ পাওয়ায় এবার দুই উপজেলার চাষিরা পাট চাষে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। মাসখানেক আগে নতুন পাট ওঠা শুরু হলে কৃষকেরা দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছেন। কিন্তু সপ্তাহ দুই হলো পাটের দাম কমে গেছে। কমতে কমতে গতকাল সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর পাটের দাম এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায় নেমে গেছে।পাটের আবাদ করতে গিয়ে এবার নানাভাবে বিড়ম্বনায় পড়েছেন চাষিরা। আবাদের সময় খরার কারণে পাটগাছগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া পাটকাটা মৌসুমের শুরুতে পানির অভাবে অনেক কৃষক পাটখেতের কাছে পাট জাগ দিতে পারেননি। তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নিয়ে গিয়ে পাট জাগ দিতে হয়েছে। এ জন্য প্রতি বিঘায় তাদের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এ ছাড়া এবার পাট আবাদের পুরো মৌসুম জুড়েই বেশি মজুরিতে কামলা খাটাতে হয়েছে। এর আগে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শ' টাকা দিন চুক্তিতে কামলা পাওয়া গেলেও এবার সাত শ' টাকার নিচে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বীজ,কীটনাশক,সারসহ চাষের অন্যান্য খরচও এবার বেড়েছে।ফলে পাট জাগ দেওয়াসহ সব খরচ মিলিয়ে গত বছরের চেয়ে এবার প্রতি বিঘায় কমপক্ষে চার হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। এছাড়া এবার বিঘা প্রতি ফলন কিছুটা কম হওয়ায় গড়ে নয় মণ ফলন পাওয়া গেছে। এতে গত বছরগুলোর তুলনায় কৃষকের প্রতি মণ পাটের উৎপাদন খরচ পাঁচ থেকে ছয় শ' টাকা বেশি হয়েছে। কৃষকেরা হিসাব দিয়ে জানান, এবার প্রতি বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করতে গিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এতে প্রতি মণ পাটের উৎপাদন খরচ দুই হাজার ২০০ টাকারও বেশি পড়েছে। মাস খানেক আগে পাটের মৌসুমের শুরুতে প্রতি মণ পাট দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় কৃষকেরা মোটামুটি লাভে ছিলেন। কিন্তু এখন নিম্নমানের পাট এক হাজার ৮০০, মধ্যমমানের পাট দুই হাজার ও উন্নত পাট দুই হাজার ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে নিম্নও মধ্যমমানের পাট বেশি হওয়ায় কৃষকদের প্রতি মণে দুই থেকে চার শ' টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।
সরেজমিনে সাঁথিয়া উপজেলার করমজা চতুরহাটে গিয়ে দেখা যায়,হাটে প্রচুর পাট উঠেছে। বেশিরভাগ পাটই বিক্রি হচ্ছে গড়ে দুই হাজার টাকার কাছাকাছি দামে। কিছু ভালোমানের পাট দুই হাজার ৩০০ টাকার মধ্যে। এমন দামে পাট বিক্রি করায় কৃষকদের বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।এদিকে পাটের হাট বসে বসেছে পাবনা ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশে ও ইছামতি নদীর ব্রিজ এর উপর।এতে প্রতিদিনই সৃষ্টি হয় ব্যপক যানজট। পাট বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের দাবি রাস্তা থেকে দুরে হাট বসানোর। প্রতি সোমবার ভোর থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ও শুক্রবার ভোর থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে হাট বসে।
ভ্যানে করে নয় মণ পাট নিয়ে এসেছিলেন বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন,আমার পাটের মান ভালো। অথচ ব্যাপারীরা প্রতি মণ ২১০০ টাকার বেশি বলতেছে না। এই দামে পাট বেচলি লোকসান হয়া যাবি।পাট নিয়ে আসা বেড়া উপজেলার খাকছাড়া গ্রামের কৃষক শামসুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,এবার পাটের আবাদে খরচ বাড়িছে।অথচ দাম পাতেছি না। এরম হলি সামনে আর পাটের আবাদ করব কিনা সন্দেহ।হাটে পাট কিনছিলেন বেড়া উপজেলার অন্যতম পাটব্যবসায়ী মানিক মিয়া। তিনি বলেন,আজ এখন পর্যন্ত ২০০ মণ পাট কিনছি। কিন্তু পাটের বাজার নিয়ে আমরাও কিছুটা সংশয়ে রয়েছি।পাটের দাম কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বেড়া উপজেলার আরেক পাটব্যবসায়ী শামসুল হক বলেন,বেড়া-সাঁথিয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে এখনও গত বছরের পাট রয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু বেড়া উপজেলার ব্যবসায়ীদের কাছেই গত বছরের অন্তত ১০ হাজার মণ পাট রয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা পাট কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন কম। তাছাড়া দুই-তিন সপ্তাহ আগে বাজারে পাটের সরবরাহ কম ছিল,তাই পাটের দাম কিছুটা চড়া ছিল। এখন বাজারে পাটের সরবরাহ ব্যাপক বেড়েছে,তাই দাম কমেছে।সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন,সাধারণত পাটের মৌসুমের সময় নতুন পাট বাজারে ওঠায় এবং পাটের সরবরাহ বেশি থাকার কারণে পাটের বাজারদর সে সময় কম থাকে। আবার সরবরাহ যখন বাজারে কমে যাবে তখন পাটের দাম বাড়বে। তবে কৃষকেদের এ বছর পাটে লাভের পরিমাণ কম হলেও খুব একটা লোকসানে নেই তারা।