এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী তাদের পেনশনের টাকার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না এর কোনো সুরাহা। এমন তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর পলাশী এলাকায় ব্যানবেইস ভবনে গিয়ে ভুক্তভোগী অনেক শিক্ষক-কর্মচারীর সঙ্গে কথা হয় এর এ প্রতিবেদকের।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন অবসরে গেছেন ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি। এখনো পেনশনের টাকা পাননি। এ পর্যন্ত তিনি ২০ বার ব্যানবেইস ভবনে এসে খবর নেন। কিন্তু প্রতিবারই তাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়।
অবসর সুবিধা বোর্ডের সামনে নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, অবসরে যাওয়ার পর থেকে পেনশনের জন্য ঘুরছি। ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগ রয়েছে আমার। পেনশনের টাকাটা পেলে চিকিৎসা করে একটু ভালো থাকার সুযোগ পেতাম। কিন্তু তা-ও হচ্ছে না। এরই মধ্যে স্ত্রী মারা গেছে। তার চিকিৎসার জন্যও ঋণ নিতে হয়েছে। সেই ঋণের টাকা দিতে না পারায় মেয়ের সংসারেও ঝামেলা চলছে।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বীররামপুর জান্নাতুল উলুম আলিম মাদরাসার সহকারী শিক্ষক কারি নূর মোহাম্মদ আমার দেশকে বলেন, ৩ বছর আগে আমি অবসরে গিয়েছি। এরপর থেকে পেনশন তোলার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।
শুধু নাসির উদ্দিন বা কারি নূর মোহাম্মদ নন-এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন হাজার হাজার শিক্ষক। জানা যায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবসর ভাতার জন্য ৪০ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য আরো ৩৯ হাজারের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীর আবেদন ফাইলবন্দি হয়ে আছে। টাকার অভাবে এসব আবেদনের কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে অবসর সুবিধা বোর্ডে ৪০ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টে ৩৯ হাজার আবেদন জমা আছে, এর বিপরীতে আট হাজার ২০০ কোটি টাকা দরকার। কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন বরাদ্দ পাওয়া না গেলে এ সংকটের কোনো সমাধান করা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জমানো ছয় হাজার কোটি টাকা যে ব্যাংকে রাখা হয়েছিল, সেটি দেউলিয়া হওয়ায় তাদের সঞ্চয়ের কোনো টাকাই এখন আর নেই। এ অর্থ হলে আমরা শিক্ষকদের অবসর সুবিধাসহ সব দায়দেনা মেটাতে পারতাম। যদিও এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, উপদেষ্টার এ বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।
কল্যাণ ট্রাস্টের প্রোগ্রাম অফিসার আব্দুল আজিজ জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশনের জন্য রয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড এবং কল্যাণ ট্রাস্ট। শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি মাসের মূল বেতন থেকে অবসর বোর্ডে ছয় শতাংশ এবং কল্যাণ ট্রাস্টে চার শতাংশ টাকা কেটে নেওয়া হয়।
কিন্তু বেতন থেকে কেটে নেওয়া অর্থে পেনশনের পুরো টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর বাজেটে এবং চাহিদামতো এককালীন থোক বরাদ্দ না দেওয়ায় ৭৯ হাজার আবেদনের স্তূপ হয়েছে। এর মধ্যে অবসর বোর্ডে ৪০ হাজার এবং কল্যাণ ট্রাস্টে ৩৯ হাজার আবেদন জমা।
অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্র জানায়, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে কেটে নেওয়া ছয় শতাংশ অর্থে সব মিলিয়ে মাসে আয় হয় ৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে যতসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী অবসরে যান, তাদের পেনশনের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২০ কোটি টাকা। ফলে প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৪৭ কোটি টাকা। এভাবে আবেদন জমতে জমতে চার বছরেরও বেশি ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র বলছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতন থেকে পাওয়া চার শতাংশ অর্থে ফান্ডে মাসে সব মিলিয়ে আয় হয় ৫২ কোটি টাকা। অথচ প্রতি মাসে আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন ৬৫ থেকে ৭০ কোটি টাকা। ফলে মাসে ঘাটতি অনেক। এ ছাড়া জুলাই বিপ্লবের পর গত সাত মাস ধরে নানা জটিলতায় কোনো কাজ হয়নি।
কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্যসচিব (রুটিন দায়িত্ব) ড. শরীফা নাসরিন বলেন, আমাদের কাছে যে ৩৯ হাজার আবেদন আছে, তা নিষ্পত্তি করতে তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। কিন্তু তহবিলে আছে ৩৯৪ কোটি টাকা। ফলে এ সংকট নিরসনে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন থোক বরাদ্দ প্রয়োজন।
জানা যায়, অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে পৃথকভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশনের টাকা পরিশোধ করা হয়। ২০২০ সালের আগস্টে যেসব শিক্ষক আবেদন করেছিলেন, তারা এখন অবসর বোর্ডের টাকা পাচ্ছেন। আর ২০২২ সালের মার্চে যারা কল্যাণ ট্রাস্টে আবেদন করেন, তারা এখন তাদের পেনশনের টাকা পাচ্ছেন।
এর আগে পেনশনের টাকা পেতে দীর্ঘসূত্রতা হওয়ায় এতদিন অসুস্থ ব্যক্তি, হজযাত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবেদন অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু গত সাত মাসে এ ব্যাপারটিও অনুপস্থিত।
এ ছাড়া এই দুই সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টই দুর্বল ব্যাংকে হওয়ায় ইতিমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে আর কোনো অর্থ ছাড় দেবে না। ফলে সেসব ব্যাংকে জমা হওয়া টাকাও তারা ব্যবহার করতে পারছেন না। এতে নতুন কোনো আবেদন নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া গত বছর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষকদের পেনশন বাবদ ১০০ টাকা করে নেওয়া হলেও সে টাকাও এ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।