নিউজ ডেস্কঃ- গত ১০ বছরে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগী বেড়ে আট গুণ ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সাড়ে তিন লাখ মানুষ চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে গিয়েছিল ও তাদের ব্যয় হয়েছিল ২০৪ কোটি ডলার। এখন যাচ্ছে প্রায় ২৭ লাখ ১০ হাজার রোগী। ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এসব মানুষ মূলত ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। এর মধ্যে রোগীর ৯২ শতাংশই যাচ্ছে ভারতে। বাকি ৮ শতাংশের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়। খুব সামান্য অংশ যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোতে।
বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের বেশির ভাগই ১৬-৫৫ বছরের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষ, যা মোট রোগীর ৮৪ শতাংশ। রোগীদের অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ ৬১ শতাংশই পুরুষ, বাকি ৩১ শতাংশ নারী।
পেশাজীবীদের মধ্যে ব্যবসায়ীরাই বেশি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভারতে যাওয়ার সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এরপর রয়েছে সিঙ্গাপুরের অবস্থান।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে মানুষ। কারণ চিহ্নিত হয়েছে আটটি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ২০১২ ও ২০২২ সালের পরিসংখ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পিএইচডি শিক্ষার্থী মুনিরা সুলতানার ২০২০ সালের নভেম্বরের গবেষণাপত্র ‘ফ্যাক্টর অ্যাফেক্টিং আউটবাউন্ড মেডিকেল ট্যুরিজম : এভিডেন্স ফ্রম বাংলাদেশ’ ও ভারতের ট্যুরিজম মিনিস্ট্রি এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেন মনে করেন, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা রয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, চিকিৎসা নিয়ে মানুষের আস্থা কম থাকায় অনেক মানুষ ভারত, ব্যাংককসহ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ চলে আসছে ঢাকায়। সবখানেই একটা আস্থাহীনতা কাজ করছে। আস্থা ফিরিয়ে আনা না গেলে মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাবেই।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল হক (পিএইচডি) বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার মূল কারণ দুটি। একটি হচ্ছে, এখনো আমাদের দেশের চিকিৎসকরা রোগীমুখী হতে পারেননি। তারা রোগীদের খুব কম সময় দেন। চিকিৎসকরা রোগীদের সঙ্গে ব্যবহারের জায়গাটা ঠিক করতে পারেননি। যেটা ভারত বা অন্য দেশের চিকিৎসকরা পারেন। প্রযুক্তির দিক থেকেও বাইরের দেশগুলো অনেক এগোনো। এখানে আমরা অনেক পিছিয়ে। বিদেশে কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা ব্যয় বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।’
তবে ঠিক কী পরিমাণ মানুষ বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে ও কত টাকা ব্যয় হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই দেশে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের এ-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা ও তথ্য নেই বলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন।
ভারতে যাচ্ছে ৯২% রোগী : ২০১২ সালে বিডার তথ্য অনুযায়ী, তখন বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বাংলাদেশের রোগীদের ব্যয় হয়েছিল ২০৪ কোটি ডলার। সে বছর গিয়েছিল সাড়ে তিন লাখ রোগী। তাদের মধ্যে ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছিল ১ লাখ ২৮ হাজার জন, যা মোট রোগীর ৩৭ শতাংশ।
বিডার সর্বশেষ (২০২১ সাল) তথ্যমতে, এখন বছরে চিকিৎসার জন্য ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে ৭ লাখ রোগী। এর মধ্যে ভারতেই যাচ্ছে ২ লাখ ৩৫ হাজার জন, যা মোট রোগীর ৩৪ শতাংশ। এতে রোগীর পরিবারের ব্যয় হচ্ছে ৪০০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
অবশ্য বিডার এই তথ্যের সঙ্গে বিস্তর ফারাক ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয় ও সে দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তাদের তথ্যে। ভারতের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর সে দেশে বাংলাদেশ চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে ২৫ লাখ মানুষ ও তাদের ব্যয় হচ্ছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার বা ৫০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ও ভারতের তথ্য সমন্বয় করে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতিবছর দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে ২৭ লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশি। এসব মানুষের চিকিৎসা নিতে সেসব দেশে ব্যয় হচ্ছে ৪৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতেই ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং দেশটিতে যাচ্ছে রোগীর ৯২ শতাংশ।
সে হিসেবে গত ১০ বছরে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা বেড়ে আট গুণ ও তাদের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে ১০ বছর আগে যেখানে মোট রোগীর ৩৭ শতাংশই যেত ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে, এখন মোট রোগীর ৯২ শতাংশই যাচ্ছে ভারতে। অর্থাৎ ভারতে যাওয়া রোগীর সংখ্যা থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
১২ রোগের চিকিৎসায় বিদেশ যাচ্ছে : মোটা দাগে ১২ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের চিকিৎসা, যা মোট রোগীর ১৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম যাচ্ছে চোখ ও দাঁতের চিকিৎসা করাতে, যা মোট রোগীর ২ শতাংশ করে। এ ছাড়া ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী কিডনি রোগের, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী অর্থোপেডিক সার্জারির জন্য, ১১ শতাংশ করে রোগী লিভার ও ক্যানসার রোগের, ৯ শতাংশ রোগী নিউরোলজি, ৬ শতাংশ রোগী গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজি, ৫ শতাংশ রোগী নাক-কান-গলা এবং ৪ শতাংশ করে রোগী জেনারেল সার্জারি ও গাইনোকলজির চিকিৎসায় বিদেশে যাচ্ছে।
মোট রোগীর ৫ শতাংশ যাচ্ছে সার্বিক মেডিকেল চেকআপের জন্য। মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ও থেরাপি নিতে যাচ্ছেন ২ শতাংশ করে রোগী। স্থূলতার চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় যাচ্ছে ৪ শতাংশ রোগী। সবচেয়ে কম যাচ্ছে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে, যা মোট রোগীর শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ।
যে কারণে বিদেশ যাচ্ছে মানুষ : এসব গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীদের ৫০ শতাংশই বিদেশে যাচ্ছে সেখানকার চিকিৎসার গুণগত মানের কারণে। ২৩ শতাংশ রোগী যাচ্ছে বাংলাদেশের চেয়ে চিকিৎসা খরচ কম হওয়ায়।
সব মিলে আট কারণে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যায় বাংলাদেশিরা। কারণগুলো হলো বিদেশে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, কম চিকিৎসা ব্যয়, সঠিক রোগ নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা চলাকালে চিকিৎসাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, মানসম্মত চিকিৎসা, রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের পর্যাপ্ত সময় ব্যয়, চিকিৎসা পেতে কম সময় অপেক্ষা ও সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান ভালো।
রোগীর ৬১% পুরুষ, নারী ৩৯% : গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মোট রোগীর অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ ৬১ শতাংশ পুরুষ ও বাকি ৩৯ শতাংশ নারী। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে যেসব রোগী যায়, তাদের বেশির ভাগই পুরুষ। এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬৪ ও ৬৯ শতাংশ। কিন্তু ভারতে যাওয়া রোগীদের অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ। এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ ও ৫১ শতাংশ।
৮৪% কর্মক্ষম শ্রেণির : গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া রোগীদের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৮৪ শতাংশই কর্মক্ষম শ্রেণির। তাদের বয়স ১৬-৫৫ বছরের মধ্যে। ৫ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু ও ১১ শতাংশ ৫৬ বছরের বেশি বয়সী। এ ছাড়া, রোগীদের মধ্যে ২৪ শতাংশের বয়স ২৬-৩৫, ২২ শতাংশের বয়স ৩৬-৪৫, ২১ শতাংশ ১৬-২৫ বছর বয়সী। রোগীদের ১৬ শতাংশ মধ্যবয়সী (৪৬-৫৫ বছর)।
তরুণরা বেশি যাচ্ছে থাইল্যান্ডে : ২৬-৩৫ বছর বয়সী তরুণ রোগীদের মধ্যে বেশি যাচ্ছে থাইল্যান্ডে, যা এই বয়সী মোট রোগীর ২৮ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ যাচ্ছে ভারতে ও ১৮ শতাংশ সিঙ্গাপুরে। ৫৬ বছরের বেশি বয়সীদের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ১৪ শতাংশ যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, ১৩ শতাংশ ভারতে ও ৭ শতাংশ থাইল্যান্ডে। আর শিশুদের বেশির ভাগ, ৬ শতাংশ সিঙ্গাপুরে, ৫ শতাংশ থাইল্যান্ডে ও ৪ শতাংশ ভারতে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বেশি যান থাইল্যান্ডে : পেশাজীবীদের মধ্যে ব্যবসায়ীরাই বেশি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান, যা মোট রোগীর ৩১ শতাংশ। ২৫ শতাংশ বেসরকারি চাকরিজীবী, গৃহবধূ ১৬ শতাংশ, শিক্ষার্থী ১০ শতাংশ, সরকারি চাকরিজীবী ৮ শতাংশ ও অবসরপ্রাপ্ত নাগরিক ৫ শতাংশ।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে, ৩০ শতাংশ ভারতে ও সিঙ্গাপুরে ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া কিছুটা সচ্ছল পরিবারের রোগীদের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৪০ শতাংশেরই মাসিক আয় ১ লাখ টাকার ওপরে। এই শ্রেণির রোগীদের ৫১ শতাংশ যাচ্ছে থাইল্যান্ডে, ৫০ শতাংশ সিঙ্গাপুরে ও ১৮ শতাংশ ভারতে।
ভারতে বেশি যায় হৃদরোগী : কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগীদের বেশিরভাগ, অর্থাৎ ২৫ শতাংশই যাচ্ছে ভারতে। এরপর বেশি যাচ্ছে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে। অন্যদিকে, নিউরোলজির রোগীরা বেশি যাচ্ছে থাইল্যান্ডে, ১৮ শতাংশ। এরপর সিঙ্গাপুরে ১২ শতাংশ ও ভারতে ৬ শতাংশ।
চোখের চিকিৎসায় বেশি যাচ্ছে ভারতে, ৩ শতাংশ। তবে দাঁতের চিকিৎসায় থাইল্যান্ডে যাচ্ছে বেশি, ৫ শতাংশ ও সিঙ্গাপুরে ২ শতাংশ।
অর্থোপেডিকের চিকিৎসায় বেশি যাচ্ছে থাইল্যান্ডে, যা মোট রোগীর ১৩ শতাংশ, এরপর সিঙ্গাপুর ও ভারতে ১০ শতাংশ করে।
ক্যানসারের রোগী বেশি যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, মোট রোগীর ১৫ শতাংশ, এরপর থাইল্যান্ডে ১১ ও ভারতে ৬ শতাংশ।
লিভারের রোগী বেশি যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, যা মোট রোগীর ১৪ শতাংশ, এরপর ১১ শতাংশ থাইল্যান্ডে ও ৯ শতাংশ ভারতে।
এ ছাড়া গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজির রোগীরা বেশি যাচ্ছে সিঙ্গাপুরে। নাক-কান-গলা ও চোখের রোগীরা ভারতে, জেনারেল সার্জারির জন্য থাইল্যান্ডে, গাইনোকোলজির চিকিৎসায় ভারত ও থাইল্যান্ডে, সার্বিক মেডিকেল চেকআপের জন্য থাইল্যান্ডে, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসায় ভারত ও থাইল্যান্ডে, থেরাপি নিতে ভারত ও সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে।