ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর মধ্যে কমপক্ষে ৫১টি নদী থেকে অবৈধভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে প্রতিবেশী ভারত। এতে শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই নদীতে পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ফলে আসন্ন সেচ মৌসুমে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কোনো কোনো খরস্রোতা নদী শুকিয়ে এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকার উদ্বেগের কথা দিল্লিকে জানিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। যৌথ কমিশনের বৈঠকসহ নদীগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে যৌথ কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে ঢাকার পক্ষ থেকে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী কমিশন সূত্র আমার দেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এদিকে চলতি সেচ মৌসুমে ভারত অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে এমন আশঙ্কাও রয়েছে নদী বিশেষজ্ঞসহ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের। পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ে ভারতকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগ দায়েরের কথা বলছেন তারা।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদ আরও এক বছর অবশিষ্ট রয়েছে। তবে এখন থেকেই ভারত বাংলাদেশকে চুক্তি অনুযায়ী পানি দিচ্ছে না। এ মুহূর্তে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনাও নেই। উপরন্তু তিস্তার উজানে ভারত অবৈধভাবে বাঁধ নির্মাণ করে নামমাত্র পানি প্রবাহ রেখে পুরোটাই প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। কর্মকর্তারা জানান, সিলেট অঞ্চলে কুশিয়ারা নদী থেকে পানি উত্তোলনে ২০২২ সাল থেকে বাধা দিয়ে আসছে ভারত। ফেনী ও তিতাস নদীসহ সীমান্তবর্তী ৭টি নদীতে ভারত মারাত্মক ধরনের ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
কিছুদিন আগে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির একজন নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পানি অবরোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এসব বিষয় নিয়ে একাধিক চিঠি দিয়ে ভারতের কাছ থেকে সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় পানিবণ্টনসহ নদী দূষণের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
গঙ্গা থেকে একতরফা পানি প্রত্যাহার
গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি অনুযায়ী এবারও পানির ন্যায্য হিস্সা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। চুক্তির তফশিল অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ৬৭ হাজার ৫১৬ কিউসেক পানি পাওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে। তবে নদীতে পানির প্রবাহ কম দেখিয়ে চলতি বছরের প্রথম দশদিনে ভারত বাংলাদেশকে ন্যায্য হিস্সার অনেক কম পানি দিয়েছে। তবে কতটুকু কম দিয়েছে যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি টিম তা সমীক্ষা করে দেখছে বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
পানির ন্যায্য হিস্সা আদায় করতে না পারার বিষয়ে ওই কর্মকর্তা জানান, নদীতে পানির প্রবাহ অনুযায়ী বাংলাদেশের হিস্সা নিশ্চিত করার বিষয়টি নির্ভর করছে। কিন্তু ভারত ফারাক্কা ব্যারেজ ছাড়াও গঙ্গা বেসিনকে কেন্দ্র করে ৭টি বড় খাল প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেক পানি গঙ্গা নদী থেকে অবৈধভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফারাক্কা নয়- গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ কমপক্ষে ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করছে ভারত। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরও অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
পানি প্রত্যাহারে অসংখ্য প্রকল্প
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারত গঙ্গা ব্যারাজের উজানে ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল ২য় পর্যায়’ এবং ‘সমান্তরাল নিম্নগঙ্গা ক্যানেল’ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করছে। এসব বৃহৎ ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে আরও কিছু সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে নিজেদের ভূখণ্ডে। এর মধ্যে রয়েছে ইস্ট গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, আগ্রা গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট, ইস্টার্ন ইয়ামুনা (যমুনা) ক্যানেল প্রজেক্ট, ওয়েস্টার্ন ইয়ামুনা ক্যানেল প্রজেক্ট, বেতওয়া ক্যানেল প্রজেক্ট, ধাসান ক্যানেল প্রজেক্ট, কেন ক্যানেল প্রজেক্ট, ঘাগর ক্যানেল প্রজেক্ট, সারদা ক্যানেল প্রজেক্ট, তেহরি ড্যাম প্রজেক্ট, লাখওয়ার ড্যাম প্রজেক্ট, তপোবন ভিষ্ণুগড় প্রজেক্ট, রামগঙ্গা মালটিপারপাস প্রজেক্ট, ধালিপুর হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাইহান্ড ড্যাম, চিলা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, তানাকপুর ব্যারেজ, কিসাউ ড্যাম, মানেরি ভালি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খারা হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, খোদরি হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, ছোবরো হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট, রাজঘাট ড্যাম, হালালি ড্যাম, গান্ধি সাগর ড্যাম, রানাপ্রতাপ সাগর ড্যাম, জাওহার সাগর ড্যাম, চম্বল ভ্যালি প্রজেক্ট, ওবরা ড্যাম, বনসাগর টোনস ড্যাম, পার্বতি ড্যাম, মাতাতিলা রিজার্ভার, রামসাগর ড্যাম, মাশানজোড় রিজার্ভার, ধাউলিগঙ্গা পাওয়ার প্রজেক্ট, তিলাইয়া ড্যাম, কনোর ড্যাম, মাইথোন ড্যাম, পানচেট ড্যাম। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং এ বিষয়গুলো চিঠি দিয়ে দিল্লির নজরে আনা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ভারত ভাগীরথী নদীর উপর জঙ্গিপুরের কাছে ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ফিডার ক্যানেল নির্মাণ করেছে। জঙ্গিপুর ব্যারাজ নামের এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হলো ফারাক্কা পয়েন্টের ৪০ হাজার কিউসেক পানি হুগলি ও ভাগীরথী নদীতে সরিয়ে নেওয়া। এর ফলে একদিকে হুগলি নদীর নাব্য বৃদ্ধি পেয়ে কলকাতা পোর্ট সারা বছর সচল থাকবে এবং অন্যদিকে ভাগীরথী নদীর বাড়তি পানি ব্যবহার করে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচ সুবিধা বৃদ্ধি করা যাবে।
এছাড়াও ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আরও একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশ’ পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ভারত সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে নদীতে পানি প্রবাহিত হতে পারছে মাত্র ১০ ভাগ।
গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ের বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমরা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সব আলোচনায় পানির ন্যায্য হিস্সার বিষয়টি এজেন্ডাভুক্ত করার চেষ্টা করি। সর্বশেষ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময়েও আমরা এসব বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বর্তমান সরকারও ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। কারণ আমাদের সেচ প্রকল্পগুলোর জন্য অভিন্ন নদীর পানির উৎস সচল রাখা অত্যন্ত জরুরি।
তিস্তায় পানি নেই
তিস্তার পানি অবৈধভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। এতে গত নভেম্বর থেকেই বাংলাদেশ এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা দূরের কথা যা পাচ্ছে তা পরিমাপ করে হিসাব করার মতো নয়, এমন অভিযোগ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের।
কর্মকর্তারা জানান, তিস্তা নদীর পানির ওপর ভিত্তি করে লালমনিরহাটসহ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলার কৃষকরা সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ নদীর নাব্য ঠিক থাকলে বাংলাদেশ কমপক্ষে দশ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। এতে স্বাভাবিক সেচ কাজ চালাতে পারেন কৃষকরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে ২০০ কিউসেক পানিও পাচ্ছে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
যৌথ নদী কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ভারত ১৯৮৭ সাল থেকেই তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ওই বছর ভারত উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে অবৈধভাবে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। ২০০০ সালের দিকে এ সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। এরপরই ভারতের সঙ্গে এ চুক্তির বিষয়টি নিয়ে জোরালো পদক্ষে নেয় বাংলাদেশ। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রতারণামূলক পদক্ষেপের কারণে এ চুক্তিটি এখনো ঝুলে আছে বলে জানান পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, চুক্তি হলেই বাংলাদেশ পানি পাবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ তিস্তার দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় তো পানিই নেই। নদীর উজানে গজলডোবাসহ কয়েকটি এলাকায় অবৈধভাবে অসংখ্য কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত।
তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মদ আবুল হোসেন আমার দেশকে বলেন, তিস্তার পানি আমাদের উত্তরাঞ্চলের কৃষির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রতি বছর সেচ মৌসুম এলে কৃষকরা বগুড়া থেকে শুরু করে উত্তরাঞ্চলের জেলা ও উপজেলাগুলোতে পানির আকুতি জানিয়ে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ে চুক্তির পাশাপাশি দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা প্রয়োজন।
কুশিয়ারায় পানি তুলতে বাধা
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুকনো মৌসুমে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর বাংলাদেশ অংশে গড়ে ৫ হাজার ২৯৫ থেকে ১৭ হাজার ৬৫০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। এ নদী থেকে বাংলাদেশ অংশে কয়েকটি পাম্পের মাধ্যমে ১৫৩ কিউসেক পানি তুলে সিলেটসহ নদীর তীরবর্তী এলাকায় কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়। এক পর্যায়ে ভারত নদীটি থেকে পানি তুলতে তীব্র বাধা দেয়। পাশাপাশি এ নদীর পানি উত্তোলনের জন্য একটি চুক্তি করতে বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয়।
২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কুশিয়ারা পানিবন্টন চুক্তি নামে বাংলাদেশ ও ভারত একটি সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পক্ষে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও ভারতের জলশক্তিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। এ চুক্তির পর ভারতের পরামর্শে নদীর তীরবর্তী এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে চারটি পাম্প হাউজও নির্মাণ করা হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ভারত এখন বাংলাদেশকে পানি তুলতে বাধা দিচ্ছে বলে জানান পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাম্প হাউসগুলো এখন অকেজো বসিয়ে রাখা হয়েছে।
ওই সময় কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলনে ভারতের সঙ্গে করা চুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন দেশের পানি বিশেষজ্ঞসহ পরিবেশবিদরা। তাদের মতে এ চুক্তি দেশের জন্য আত্মঘাতী ও সার্বভৌমত্ববিরোধী। বাংলাদেশ ভাটির দেশ হিসেবে এ চুক্তি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনের স্পষ্ট লংঘন। ভারতকে খুশি করার জন্যই শেখ হাসিনার সরকার এ চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে।
চুক্তির পর আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নদী বিশেষজ্ঞ ও যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান বলেছিলেন, এই সমঝোতা স্বাক্ষরটি অসঙ্গতিপূর্ণ। কারণ কুশিয়ারার যে অংশের জন্য সমঝোতা হয়েছে, সেই অংশটি পুরোপুরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এই সামান্য পরিমাণ পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রত্যাহার করার জন্য বাংলাদেশকে যদি ভারতের অনুমতি নিতে হয়, তা অযৌক্তিক ও অনৈতিক।
আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ আমার দেশকে বলেন, আমাদের শাসকগোষ্ঠীর নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও পানির ন্যায্য হিস্সা আদায় হয়নি। বিগত সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের স্বার্থে একের পর এক গণবিরোধী চুক্তি করেছে।
এ অধ্যাপক আরও বলেন, দুই দেশের অভিন্ন ৫৪টি নদীর ৫১টি নদীতে আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করে ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উজানে অসংখ্য বাঁধ, ব্যারেজ দিয়েছে এবং ভিন্ন খাতে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। ভারতের এই পানি আগ্রাসনের কারণে গোটা বাংলাদেশ আজ মরুকরণের দিকে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আন্তর্জাতিক নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
ভারতের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আনু মোহাম্মদ বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার একে অপরের ওপর দায় দিয়ে নানা ধরনের টালবাহানা করছে। মূলত ভারত বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্সা দেবে না। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে দ্রুত আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া। কারণ ভারত যেটা করছে, তা আন্তর্জাতিক নদী আইন ও রীতিনীতির স্পষ্ট লংঘন। আমাদের কৃষিকে ও পরিবেশ বাঁচাতে এ ছাড়া সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।
যা বলছেন উপদেষ্টারা
ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ের বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আমার দেশ’র এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ভারত অন্যায়ভাবে অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে আমাদের জীববৈচিত্র্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ের বিষয়টিকে সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। গঙ্গাচুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে অভিন্ন নদী রয়েছে সেগুলোর পানির ন্যায্য হিস্সা বাংলাদেশকে দিতে ভারত বাধ্য। পানি না দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। পানির ন্যায্য হিস্সা আদায় করতে ভারতকে রাজনৈতিক, সামাজিকভাবে চাপ দিতে হবে।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ভারতের পানি আগ্রাসন নিয়ে আরও বলেন, ভারতে যখন পানির চাপ থাকে তখন আমাদের এখানে স্লুইসগেটগুলো খুলে দেয়। আবার ওদের ওখানে যখন পানি স্বল্পতা থাকে তখন স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করে দেয়। তারা এটা ইচ্ছামতো করছে, সেজন্য আমরা পানি পাচ্ছি না। এতে আমাদের চাষাবাদে সমস্যা হচ্ছে। গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল নিয়ে সমস্যা আমরা কত আর সহ্য করব। পানির ব্যাপারে শুধু ফারাক্কা নয়, অভিন্ন যে ৫৪টা নদী আছে সেগুলোর ন্যায্য হিস্সা অনুযায়ী পানি যেন বাংলাদেশ পায় সেজন্য আমরা কাজ করব।
সুত্র – আমারদেশ