ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আঞ্চলিক রাজনীতির ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতেও। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অজুহাত দেখিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশিদের পর্যটন ভিসা দিচ্ছে না। গুরুতর রোগী ছাড়া অন্যদের আটকে দিচ্ছে মেডিকেল ভিসা।
দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা থেকে আগতদের চিকিৎসা না দেওয়ার। ফলে বাংলাদেশিরা থাইল্যান্ড যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার থাকা-খাওয়াসহ আনুষঙ্গিক খরচও দিল্লির কাছাকাছি হওয়ায় বেড়েছে ব্যাংকক যাওয়ার প্রবণতা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ভারতের ভিসা বন্ধের পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ সরকার। রোগীরা কেন বিদেশে যায়, সে বিষয়ে ভালো গবেষণা করে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান উন্নত করতে হবে। আমাদের বেসরকারি হাসপাতালও এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। সেবার মান বাড়িয়ে ভারতনির্ভর রোগীদের টানতে পারে। সরকারকেও বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।ভিটামিন ও সাপ্লিমেন্ট কিনুন
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৫ লাখের মতো রোগী ভারত যান। স্বাস্থ্যসেবা নিতে তাদের খরচ করতে হয় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসছে, ভারতমুখী লাখ লাখ বাংলাদেশির গন্তব্য কোথায়? থাইল্যান্ডে সরেজমিন দেখা যায়, চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশিদের কাছে ভারতের বিকল্প বাজার হয়ে উঠছে থাইল্যান্ড।
চিকিৎসার জন্য বড় অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি বেছে নিচ্ছে। ইদানীং থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইটেও বেড়েছে যাত্রীর চাপ। থাইল্যান্ডে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা জানান, সহজ ভিসা, স্বল্প সময় ও কম বিমান ভাড়া, উন্নত চিকিৎসা, সুলভ মূল্যে থাকা-খাওয়া, আকর্ষণীয় পর্যটন, প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমসহ নানা সুবিধা বিবেচনায় তারা থাইল্যান্ডে ঝুঁকছেন।
ভারতের তুলনায় ২৫% কমে উন্নত চিকিৎসাঃ
চিকিৎসার জন্য বেশির ভাগ বাংলাদেশি এসে ওঠেন রাজধানী ব্যাংককের সুকুমভিত এলাকার বিভিন্ন হোটেলে। এ এলাকায় বামরুনগ্রাদসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে। সস্তায় যেমন আবাসন মেলে, তেমনি রয়েছে বাংলা খাবারের হোটেল। বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের প্রবেশপথ সুকুমভিত সয়-৩-এ সড়কের পাশে চোখে পড়ল বাংলা খাবারের ‘মনিকাস কিচেন’ ও ‘স্টার রেস্তোরাঁ’। বাংলা নামের সঙ্গে সাইনবোর্ডে লেখা, ‘ঘরোয়া পরিবেশে বাংলা খাবার পরিবেশন করা হয়’। রয়েছে হালাল খাবারের নিশ্চয়তাও। গত মঙ্গলবার মনিকা’স কিচেনে পাওয়া গেল অন্তত ৪৫ বাংলাদেশি, যাদের অধিকাংশ চিকিৎসা নিতে এসেছেন। কয়েকজন জানালেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত ভিসা বন্ধ করায় মানুষ বাধ্য হয়ে থাইল্যান্ড আসছেন। এখানে ভারতের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম খরচে উন্নত চিকিৎসা মিলছে। হোটেলে ডাবল খাটের এক কক্ষের ভাড়া তিন হাজার, বিমানে লাগে ২৮ থেকে ৩০ হাজার। মোটামুটি মানের খাবারে খরচ বাংলাদেশের মতোই।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ এক বছর ধরে মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভুগছেন। দেশে চিকিৎসকরা কোমরের হাড়ক্ষয় জানিয়ে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছেন। ফয়েজ বলেন, ভারত যেতে চেয়েছিলাম। আড়াই মাস ঘুরেও ভিসা পাইনি। ২৫ নভেম্বর থাইল্যান্ডের ব্যাংকক হাসপাতালে অপারেশন করিয়েছি। এখন অনেকটাই সুস্থ। আরও কিছুদিন থাকতে হবে। কম খরচে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসা পেয়েছি। থাই আতিথেয়তাও মুগ্ধ করেছে।
অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আগে আমি ভারতে চিকিৎসা নিয়েছি। খরচ প্রায় সমান হলেও, সেবার মানে এগিয়ে থাইল্যান্ড। ঢাকা থেকে চেন্নাই আসা-যাওয়ায় বিমান ভাড়া ২২ হাজার টাকা, থাইল্যান্ডের জন্য লেগেছে ২৮ হাজার।’
চিকিৎসার জন্য পরিবার নিয়ে থাইল্যান্ডে নিয়মিত যান নোয়াখালীর ব্যবসায়ী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংককের চিকিৎসার মান আন্তর্জাতিক মানের; খরচ কম। বিমান ভাড়া কমলে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি যাবেন দেশটিতে।
থাইল্যান্ডে প্রায় ১ হাজার হাসপাতাল আছে। এর মধ্যে ৪৭০টির বেশি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতালও ব্যাংককে। যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনালের প্রত্যয়নে চলছে ৬২টি হাসপাতাল।
বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালের সহ-প্রধান নির্বাহী ডা. নিপাত কুলাবকা বলেন, গত কয়েক মাসে বাংলাদেশি রোগী ২০ শতাংশ বেড়েছে। আরও বাড়বে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডে আসতে বিমানে সময় কম লাগে। চিকিৎসার পাশাপাশি প্রাকৃতিক পর্যটনও আকর্ষণীয়। স্বল্প খরচে সব সেবা, উন্নত চিকিৎসা প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও থাইল্যান্ডে মেডিকেল ট্যুরিজমে গুরুত্ব দিচ্ছে। অনেক হাসপাতালের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বামরুনগ্রাদের মতো বড় হাসপাতালে যেমন চিকিৎসা প্যাকেজ দিচ্ছে, তেমনি একেবারে কমদামে সরকারি বা মিশনারি হাসপাতালেও চিকিৎসার সুযোগ করে দিচ্ছে।
ট্রেফেল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুন বলেন, থাইল্যান্ডকে এখন সব দিক থেকেই ভারতের চেয়ে ভালো বিকল্প মনে হচ্ছে। বাংলাদেশিদের জন্য এখানকার হাসপাতালে স্বল্প খরচ বিবেচনায় প্যাকেজ নিয়েছি। এসব প্যাকেজে দারুণ সাড়া মিলছে। তিনি আরও বলেন, বিমান সংস্থাগুলো চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু করলে থাইল্যান্ড অবশ্যই চিকিৎসা-পর্যটনে ভারতের দারুণ বিকল্প হবে।সেরা ট্যুর প্যাকেজ
ব্যাংককভিত্তিক মেডিকেল ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুয়া নোই ফিট অ্যান্ড ফ্লাইয়ের ব্যবস্থাপক মাজেদুল নয়ন জানান, তাদের কাছে চার মাস আগের তুলনায় এখন ২০০ শতাংশ বেশি কল-মেসেজ আসছে। ৮০ শতাংশের বেশি রোগী পরিকল্পনা থাকলেও ভিসা জটিলতায় ভারতকে বাদ দিয়ে থাইল্যান্ড আসতে চাচ্ছেন।
ট্রিপ মেকারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী হাসানুজ্জামান রনি বলেন, এখন আমাদের কাছে ভারতগামী কোনো রোগী আসছেন না। অথচ আগে মাসে অন্তত ১৫ জন আসতেন। গত মাসে নতুন আটজনসহ থাইল্যান্ড গেছেন ১১ রোগী। শ্রীলঙ্কার চিকিৎসাও ভালো। এটিও হতে পারে ভারতের বিকল্প। সরকার এভারকেয়ার, ইউনাইটেডের মতো বড় বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে, যাতে দরিদ্র রোগীরাও সেবা নিতে পারেন।