আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান শহীদ দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে, উত্তাল হয়ে উঠেছিল বগুড়ার মাটিও। ভাষা আন্দোলনের ৭২ বছর পরেও বগুড়ার মানুষের মনে সেই চেতনার আগুন আজও জ্বলছে। অমলিন হয়ে আছে রক্তিম ইতিহাস।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের সংবাদ বগুড়ায় পৌঁছালে সেখানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সেদিন বগুড়ায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়, এবং ছাত্র ও জনসাধারণের সম্মিলিত এক বিরাট শোভাযাত্রা শহর প্রদক্ষিণ করে "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" স্লোগান দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলতাফুন্নেছা মাঠে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পূর্ববঙ্গ পরিষদের সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানানো হয়।
বগুড়ার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গঠন। এই পরিষদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের নেতারা একতাবদ্ধ হয়ে আন্দোলন পরিচালনা করেন।
বগুড়ার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা ক্লাস বর্জন করে মিছিলে অংশ নেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় বগুড়ার কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনমত তৈরি করেন। তারা গান, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনগণের কাছে তুলে ধরেন।
বগুড়ার নারীরাও ভাষা আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলেন না। তারা মিছিলে অংশ নেন এবং আহত ছাত্রদের সেবা করেন।
ভাষা আন্দোলনে বগুড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অবদান : ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা ও সাহিত্যকর্মী মুহম্মদ আবদুল মতীন। মিছিলটি সাতমাথায় পৌঁছালে মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা হামলা চালায়, ফলে আবদুল মতীনসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন
একই বছরের ১১ মার্চ, আজিজুল হক কলেজ থেকে ছাত্র-জনতার মিছিল বের হয়। মিছিলটির নেতৃত্ব দেন অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং পরবর্তীতে বগুড়া জেলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন। তিনি বাংলা ভাষার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন এবং আন্দোলনকে উৎসাহিত করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রদের সাথে মিছিলে অংশ নেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের সংগঠিত করতে এবং তাদের মধ্যে আন্দোলনের চেতনা জাগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অধ্যাপক গোলাম রসুল ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক।
অধ্যাপক আবুল খায়ের ভাষা আন্দোলনের সময় ছাত্রদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।
মজিরউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ এবং ভাষা আন্দোলনের কর্মী। তিনি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
আবদুল আজীজ কবিরাজ ছিলেন একজন কৃষক নেতা এবং ভাষা আন্দোলনের কর্মী। তিনি কৃষকদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং তাদের এই আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন।
ভাষা আন্দোলনে ছাত্রনেতা হিসেবে গোলাম মহিউদ্দিনের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছাত্রদের মধ্যে বাংলা ভাষার অধিকারের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেন।
আরো অবদান রেখেছেন, শেখ হারুনুর রশীদ, জমিরউদ্দিন মণ্ডল, ছাত্রনেতা আবদুস শহীদ, শ্রমিক নেতা সুবোধ লাহিড়ী, মোখলেসুর রহমানসহ প্রমুখ।
ভাষা আন্দোলনে বগুড়ার মানুষের আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এই চেতনা আজও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।