কংকনা রায়, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরএলাকার স্বজনপুকুর গ্রামের বাসিন্দা প্রবাসী জাকির হোসেন। জীবিকার তাড়নায় দেশ ও স্বজন ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্য সৌদি আরব ও কুয়েতে। প্রায় ২ দশক প্রবাস জীবন কাটান তিনি।
ফিরে আসেন দেশে। কিন্তু ফিরে আসার পূর্বে তিনি মরুর ফল চাষ পদ্ধতি আয়ত্ব করেছিলেন। সেজন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন খেজুরের বীজ। তা দিয়ে বাড়িতেই চারা উৎপাদন করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন প্রবাসী জাকির হোসেন। রোপণকৃত চারা থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে খেজুর গাছ। সেগুলোতে ধরছে ফল। আর সে ফলের মিষ্টতা এখন জেলাজুড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্বজনপুকুর গ্রামে বাড়ি ২০ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক ১৯টি খেজুর চারা রোপণ করেছিলেন জাকির হোসেন। চাষ করে আশানুরূপ ফলন পান তিনি। বর্তমানে দুই একর জমিতে তার এ খেজুর বাগান। তিনি মরুর দেশ সৌদির খেজুর চাষের পাশাপাশি বিক্রি করছেন চারাগাছ। তার সাফল্য দেখে তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে আশপাশের অনেকেই বাগান করেছেন। অনেকে চারার চাহিদা দিয়ে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে রেখেছেন। এদিকে গাছে ফল আসলেই প্রতিবছর ভিড় জমছে দর্শনার্থীদের। অনেকে স্বাদ নিচ্ছেন খেয়ে।
জানা যায়, বিদেশ থেকে বাড়ি ফেরার সময় ১২ কেজি পাকা খেজুর এসেছিলেন জাকির হোসেন। নিজে সেগুলো চারা বানান। পরে ২০ শতক জমিতে করেন বাগান। তার সে বাগানে আজওয়া, মরিয়ম, খলিজি, মেডজুল, বারহি ও আম্বার জাতের খেজুর গাছ রয়েছে। এগুলোর বয়স চার থেকে ছয় বছর। ২০২২ সালে তার বাগানে প্রথম তিনটি গাছে ফল আসে। পাশাপাশি দেড় একর জমিতে রোপণ করেছেন ড্রাগন, আমড়া, কমলা, মাল্টা, নারিকেল, বারোমাসি কাঁঠাল, আঙুরসহ লেবু গাছ।
উদ্যোক্তা জাকির হোসেন বলেন, জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাতে হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় সেখানে চাষ হাওয়া খেজুর দেখে আমারও স্বপ্ন জাগে, দেশের মাটিতে মরুর খেজুর চাষ করার। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে খেজুর এনে পরীক্ষামূলক চারা তৈরি করি। ইউটিউবের সহায়তা নিয়ে আরাবি চ্যানেলে দেখি কিভাবে গাছের পরিচর্যা করতে হয়। একসময় সাফল্যের মুখ দেখতে পাই। তিনটি গাছে প্রচুর পরিমাণে ফল আসে। তারপর সে ফলগুলো মানুষকে খাওয়ানোসহ কিছু চারা করি। এ বছর ৯টি গাছে ফল এসেছে। প্রতিটি গাছের ৮/৯টি কাঁদিতে (গোছায়) ১০০ কেজির অধিক খেজুর হয়। প্রতি কেজিতে ৫০টির মতো খেজুর ওঠে।
তিনি আরো বলেন, খেজুরের বীজ থেকে চারা গাছ হতে প্রায় দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। এ খেজুর বাগান করতে প্রয়োজন উঁচু জমি। চারাগাছ রোপণের কয়েক বছরেই ফল আসতে শুরু করে। আমি বর্তমানে প্রতিটি চারা বিক্রি করছি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। শুধু উত্তরবঙ্গই নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে চারাগাছ ক্রয়ের চাহিদা আসছে। এ খেজুর গাছ ৭০ থেকে ৮০ বছর ফল দেয়। আমার বাগানে উৎপাদিত খেজুর ৫০০ থেকে সাড়ে ৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে দেড় হাজার চারা প্রায় ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি।
বাগান সংলগ্ন বাসিন্দা আবদুল আলীম ও প্রভাষক আলমগীর হোসেন জনি বলেন, বাড়ির কাছেই এখন সৌদির খেজুর বাগান। ছোট্ট এই গাছগুলোতে যে এতো খেজুর হয়, কল্পনার বাহিরে। আমরা স্থানীয়রা সবাই এ খেজুরের স্বাদ নিয়েছি, অনেক সুস্বাদু খেজুর। এ বাগান দেখতে প্রতিবছর বিভিন্নস্থান থেকে দর্শনার্থীরা এসে ভিড় জমান।
দিনাজপুর থেকে চারা কিনতে আসা রফিকুল ইসলাম রাব্বী বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই বাগানের ভিডিও দেখেছি। জাকির হোসেনের সাফল্য দেখে আমিও উদ্বুদ্ধ হয়েছি। আমি চারাগাছ সংগ্রহ করতে এসেছি। এ চারাগাছ নিয়ে আমিও বাগান করবো।
ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রুম্মান আক্তার বলেন, দিনাজপুর একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। এ অঞ্চলকে মানুষ চাল-লিচুর খ্যাতির জন্যই বেশি চিনে। প্রবাসী জাকির হোসেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে খেজুর এনে তা চারা করে গাছ রোপণ করেছেন। মরু দেশের খেজুর এখন ফুলবাড়ীতেই ফলছে। এটি খুবই চমৎকার ও গর্বের বিষয়। আমরা তার বাগান পরিদর্শন করেছি। খুবই ভালো ফলন হয়েছে। এ খেজুর দেশের চাহিদা মিটাতে ভূমিকা রাখবে।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক মো. নূরুজ্জামান বলেন, প্রবাসী জাকির হোসেন মরুর খেজুর দিনাজপুরের মাটিতে ফলিয়ে অনন্য নজির গড়েছেন।
তিনি খেজুর বাজারজাতসহ চারাগাছও বিক্রি করছেন। তাকে আমাদের পক্ষ থেকে সবধরণের সহযোগিতা দেয়া হবে।