লুৎফর রহমান, লালমনিরহাট প্রতিনিধি:সন্তানের খুনিদের বিচার চাই। তবে আমার জীবন থাকতে আমার কলিজার কলিজা কাটতে দিমু না।
আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আদর ভালবাসা দিয়ে আদরের সন্তানকে কবরে শেষ বিদায় দিয়েছি। তার লাশ আর তুলতে দিব না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত মিরাজুল ইসলাম মিরাজের মা মোহসেনা বেগম এমন করে আকুতি জানান গনমাধ্যমে।
মিরাজুল ইসলাম মিরাজ লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া আনছার খাঁর পুকুরপাড় এলাকার আব্দুস ছালামের ছেলে। নিজ গ্রামে পারিবারিক করবস্থানে গত ৮ আগস্ট তাকে দাফন করা হয়।
মিরাজ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মিরাজের লাশ উত্তোলন করে মর্গে পাঠাতে ইতোধ্যে ঢাকা সিএমএম আদালত লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, স্থানীয় মহিষখোচা বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালে এসএসি পাশ করে সিএনজি চালক বাবা’র সাথে ঢাকা যাত্রাবাড়ি এলাকায় পাড়ি জমান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতেন মিরাজের পুরো পরিবার। ঢাকা দনিয়া মডেল স্কুল এন্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি বিকাশ দোকানের কর্মচারী ছিলেন মিরাজ। অসুস্থ্য বাবার চিকিৎসা ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়াসহ পুরো সংসার চলত মিরাজের আয়ে। বাবার চিকিৎসায় ৩/৪ লাখ টাকা ঋনও করেছেন মিরাজ। সেই ঋন পরিশোধে আর সংসারের হাল ধরতে লেখাপড়ার পাশাপাশি দোকান কর্মচারী হন মিরাজ।
গত ৫ আগস্ট হাসিনা হঠাওয়ের এক দফা আন্দোলনে অন্যদের মত যাত্রাবাড়ি থানার সামনে মাছের আড়ত এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন মিরাজ। তার খালাত ভাই কারখানা শ্রমিক মাজেদুল ইসলামও তার সাথে যোগ দেন মিছিলে।সেখানে পুলিশের গুলিতে দুই ভাই মিরাজ ও মাজেদুল গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয়রা তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরদিন সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় মিরাজকে। অস্ত্রপাচার করে মিরাজের শরীর থেকে গুলি বের করা হলেও এর দুই দিন পর ৮ আগস্ট মারা যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ। তার সাথে যাওয়া গুলিবিদ্ধ খালাত ভাই মাজেদুল ইসলাম চিকিৎসা নিয়ে বর্তমানে সুস্থ্য রয়েছেন।
মিরাজের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা আব্দুস ছালাম বাদি হয়ে লালমনিরহাট জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন এমপিকে প্রধান করে সাবেক সমাজকল্যান মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদসহ ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২/৩ শত জনের বিরুদ্ধে ২৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ি থানায় একটি হত্যা মামলা ( নং-১৭(৮) ২৪) দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের স্বার্থে মৃত মিরাজের ভিসেরা(ময়না তদন্ত) প্রতিবেদনের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট
আদালতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। যার প্রেক্ষিতে ঢাকা সিএমএম আদালতে বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক লাশ উদত্তোলনে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে লালমনিরহাট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেন।
এদিকে কোন ভাবেই লাশ উত্তোলন করতে দিতে রাজি নন মিরাজের মা মোহসেনা বেগম। সার্বক্ষনিক পাহারা দিচ্ছেন মেধাবী সন্তানের করব। কেউ আসা কথা শুনলেই দৌড়ে যান ছেলের কবরের পাশে। যাতে কেউ লাশ তুলতে না পারে সেজন্য প্রায় নির্ঘুম রাতও কাটছে তার।
মিরাজের মা মোহসেনা বেগম বলেন, সন্তানের খুণিদের বিচার চাই। তবে আমার জীবন থাকতে আমার কলিজার কলিজা কাটতে দিমু না। আমার কলিজার টুকরা সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। আদর ভালবাসা দিয়ে আদরের সন্তানকে কবরে শেষ বিদায় দিয়েছি। তার লাশ আর তুলতে দিব না। প্রয়োজনে আমি মা জীবন দিব, তবুও সন্তানের লাশ তুলতে দিমু না।
তবে মিরাজের বাবা মামলার বাদি আব্দুস ছালাম বলেন, শুনেছি মামলার তদন্তের স্বার্থে ছেলের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হবে। যদি মামলার স্বার্থে তা করতেই হয়। তাহলে আপত্তি নেই। তবুও আইনজীবিদের সাথে বসে যদি লাশ উত্তোলন ছাড়াও বিচারের পথ থাকে তবে লাশ উত্তোলন না করার আবেদন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের সাথে মৌখিক আলোচনাও করেছি।
লাশ উত্তোলনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা আদিতমারী থানার উপ পরিদর্শক(এসআই) আমিনুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশনা পেয়েছি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে দিনক্ষন নির্ধারন করে দিলে মিরাজের লাশ উত্তোলন করে লালমনিরহাট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে।
আদিতমারী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মাহমুদ উন নবী বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে লাশ উত্তোলনের দিনক্ষন নির্ধারন করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চিঠি আসেনি। আসলে নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপাতত ঢাকা সিএমএম আদালতের আদেশের অনুলিপি পেয়েছি।