চলতি তাপদাহে রংপুরে বোরো ধান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কৃষক। ফলন বিপর্যয় ঠেকাতে ঘনঘন সেচ দিয়ে ক্ষেতকে সতেজ রাখছেন তারা। গরম বাড়ার সঙ্গে বোরোক্ষেতে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। পোকামাকড় দমনসহ ধানের ব্লাস্ট রোগে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন কৃষক। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। অপরদিকে তাপদাহ আরও বাড়লে ধানের পরাগায়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে ফলন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় উৎপাদিত ধানের মূল্য নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন কৃষক।
জানা গেছে, সেচনির্ভর হলেও রংপুরের কৃষকদের বোরো আবাদে ঝোঁক বেশি। প্রতি বছরের মতো এবারও জেলার মাঠজুড়ে বোরো ধানের ক্ষেত। এবার ব্রি-২৮, ব্রি-৭৪, বঙ্গবন্ধু-১০০, হাইব্রিডসহ বিভিন্ন জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। চলতি সপ্তাহে তাপদাহে দেশজুড়ে হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অতিক্রম করার পূর্বাভাস রয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, অত্যধিক গরম থেকে রক্ষায় ক্ষেতে ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি পানিতে ধানের গোড়া ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে আর্দ্রতার ঘাটতি হবে না। এদিকে ৩৫ ডিগ্রির অধিক তাপমাত্রা হলে ধানের পরাগরেণু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হিট শকের কারণে শিষে চিটার পরিমাণ বেড়ে যায়। দিনে অধিক গরম ও রাতে ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করলে ক্ষেতে ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। রংপুরে দিনে অত্যধিক গরম ও রাতে ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে। এতে ব্লাস্টের সংক্রমণ হতে পারে বলে মনে করছেন কৃষকরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, তাপপ্রবাহের কারণে বোরোক্ষেতগুলোয় পানি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও পানির অভাবে ক্ষেতের মাটি ফেটে গেছে। কৃষকরা ক্ষেত রক্ষায় ঘনঘন পানি সেচ দিচ্ছেন। ধানগাছের গোড়া তিন-চার ইঞ্চি পানিতে ডুবিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে তাপদাহের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে গরম বাড়ার কারণে মাজরা পোকার আক্রমণ বেড়েছে। তাই পোকা দমনসহ ব্লাস্ট থেকে বোরো বাঁচাতে কীটনাশক প্রয়োগ করছেন; তবে যেসব ক্ষেতে ধানের শিষ বেরিয়েছে, তাপদাহ বাড়লে সেসব ক্ষেতের শিষে চিটা হওয়ারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
নগরীর বকসি এলাকার কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কন্ট্রাক নিয়া চাইর দোন মাটিত ধান আবাদ করছি। যে গরম পড়ছে, ধানের গাছ বাঁচাবার জন্তে ক্ষ্যাতোত ঘনঘন পানি দিতোছি। হামার খরচা বাড়ি যাইতোছে। ক্ষ্যাতোত মাজরা পোকাও ধরছে। থাকি থাকি স্প্রে করতোছি।’
মহিন্দ্রা এলাকার কৃষক আসাদুল মিয়া বলেন, ‘রোদের কারণে দুয়েক দিন পরপর জমিতে পানি দিতে হচ্ছে। মাজরা পোকা মারার ওষুধ দিচ্ছি। গরমে পঁচানীর ওষুধও দেওয়া লাগতেছে। এবার ধানের উৎপাদন খরচ বাড়বে। সিজনে ভালো দাম না পাইলে ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
একই এলাকার জহুরুল ও আঙ্গুর মিয়া বলেন, ‘এইবার চাষের দাম বেশি, সারের দাম বেশি, পানি দিতোছি, সেইটারও দাম বেশি। গরমের জন্তে দুই-এক দিন বাদ জমিত পানি দিতোছি। বাঁচি থাকবার গেইলে তো আবাদ করি খাওয়া লাগবে। ধানের দাম ভালো হইলে পোষাইবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর ১ লাখ ৩২ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘দেশব্যাপী হিটওয়েভ চলছে। তবে ভালো খবর হলো রংপুরে বেলা ১টার পর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধানের পরাগায়ন হয় বেলা ১১টার মধ্যে। তাই এই তাপদাহ পরাগায়নে কোনো ক্ষতি করবে না। বিরূপ আবহাওয়া মোকাবিলায় ব্লক পর্যায়ে কৃষকদের ধানক্ষেতে পানিসহ রোগবালাই দমনে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি, এ তাপদাহ থেকে ক্ষেত রক্ষা করা যাবে এবং বিগত বছরের তুলনায় উৎপাদন বাড়বে।’
রংপুর আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রবিবার বেলা ৩টায় রংপুরে ৩৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, রংপুরে বিভাগে দিনের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যে অস্বস্তি লাগবে। তাপদাহের বিষয়টি মাথায় রেখেই ফসল রক্ষায় কৃষকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।