দাঙ্গা* দমন ও অপারেশনাল সরঞ্জাম ক্রয়ে বরাদ্দের অতিরিক্ত ১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত পুলিশ সদর দফতর।
কয়েক মাস পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পতনের একদফা দাবি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। এ কারণে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।/ তবে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রোডম্যাপ তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর সেই রোডম্যাপ অনুযায়ীই চলছে নিরাপত্তা প্রস্তুতি।
রোডম্যাপে প্রাধান্য পাচ্ছে দাঙ্গা দমন সামগ্রী ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদি মজুত, অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ, জ্বালানি খাতের বাজেট ১০০ ভাগ খরচ, টার্গেটকৃত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে বিশেষ অভিযান, /মোস্ট ওয়ান্টেট ও চিহ্নিত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা, পুরোনো মামলা সচল, ব্লকরেইড, সাঁড়াশি অভিযান প্রভৃতি।
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে সর্বোচ্চ ৮০ ভাগ বাজেট ব্যয় করা যাবে।/ কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচন এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হলে পুলিশের মোবিলিটি বাড়বে।
এছাড়া নবসৃষ্ট পদের বিপরীতে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন হয়েছে। এ কারণে মোটরযানের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাবদ ব্যয় বেড়েছে।/ তাই জ্বালানি খাতে সরকারের কাছে পুলিশের জন্য শতভাগ খরচের অনুমতি চাওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত দাঙ্গা দমন ও অপারেশনাল সরঞ্জাম মজুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের জন্য ২০-২২-২৩ অর্থবছরে যে বরাদ্দ ছিল সেই বরাদ্দের অতিরিক্ত হিসাবে সরকারের কাছে এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।/ গত সেপ্টেম্বরে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি আতিকুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি বরাদ্দপত্র জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে দেওয়া হয়। তবে এখনো সেটি অনুমোদন হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা আতিকুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশ বাহিনীর জন্য যে পরিমাণ দাঙ্গা দমন সামগ্রী ও অপারেনশনাল সামগ্রী রয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল।/ এসব সামগ্রী দিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে। তাই পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, সফটওয়্যার, অপারেশনাল ও নিরাপত্তা সামগ্রী ক্রয়ের জন্য থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া গেলে ১৫৮ কোটি সাত লাখ ১৭ হাজার ২৫০ টাকার অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনা হবে। নিরাপত্তা সামগ্রী কেনা হবে ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার।/ যানবাহন কেনা হবে ২২৬ কোটি পাঁচ লাখ টাকার। অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কেনার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪০ কোটি সাত লাখ টাকা। তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি সামগ্রী কেনা হবে ১২ কোটি টাকার। কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা। উন্নত মানের সফটওয়্যার বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি ছয় লাখ টাকা। নির্বাচনের সময়ের জন্য পেট্রোল, অয়েল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ২০৪ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৬১০ টাকা।
পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, সারা দেশে বিএনপি ও জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের তালিকা এখন পুলিশের হাতে।/ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে জেলা, মহানগর, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডভিত্তিক যেসব কমিটি আছে সেগুলোর তালিকা পুলিশের উচ্চ পর্যায়সহ থানাগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তালিকা বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক নেতাকর্মীদের নজরদারিতে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ আগেই।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে মামলার ক্ষেত্রে কমিটি ধরে আসামি করতে থানা পর্যায়ে অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।/ কমিটির সবাইকে আসামি করতে গিয়ে দেখা যায়, অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি এবং প্রবাসীদেরও মামলার আসামি করা হয়েছে। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তাই সামনের দিনগুলোতে গণহারে আসামি করার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খেয়াল রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, যেসব নেতাকর্মীর নামে পুরোনো মামলা আছে সেগুলো সচল করার পাশাপাশি ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিদের গ্রেফতারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এ সংক্রান্ত অভিযান তত জোরদার করা হবে।/ বাড়বে ব্লকরেইড এবং সাঁড়াশি অভিযান। চিহ্নিত অপরাধী গ্রেফতার এবং অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের জন্য এরই মধ্যে কয়েক দফায় বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। দেশব্যাপী আরও কয়েক দফায় এ ধরনের অভিযান চালানো হবে।
সম্প্রতি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো ১০ দফা দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে।/ চলমান আন্দোলন বেগবান করতে তারা শক্ত অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। শিগগিরই তারা এক দফা আন্দোলনে মাঠে নামতে পারে। চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে নিজেরাই পরিকল্পিত নাশকতা তৈরি করে দায়ভার সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপাতে পারে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
বিএনপির কর্মসূচিতে জঙ্গিগোষ্ঠী জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী প্রবেশ করে উসকানি দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির অপচেষ্টা চালাতে পারে।/ সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। মহানগর এবং জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা জোরদারসহ সিসিটিভি স্থান ও মনিটরিং করার সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
সম্ভাব্য অস্থিরতা মোকাবিলার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের প্রস্তুতি চলছে।/ পুলিশের অপারেশন্স শাখা থেকে একটি রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। এতে কী আছে সে বিষয়ে এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলতে পারি, সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। পুলিশ একটি পেশাদার বাহিনী। পেশাদারিত্বের সঙ্গেই সব ধরনের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সামনের দিনগুলোতে আমাদের বিশেষ অভিযান জোরালো হবে/।