সাধারণ নিয়মে টাকার বিনিময়ে পণ্য বিক্রি হলেও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কান্দাপাড়া, শিয়ালকোল, কাজিপুরের নাটুয়ারপাড়াসহ জেলা বিভিন্ন এলাকার হাটের বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ নিজেই পণ্য। নির্ধারিত একটি সময়ের জন্য একজন আরেকজনের কাছে বিক্রি হয়ে যান।
সিরাজগঞ্জের কান্দাপাড়া, শিয়ালকোল, কাজিপুরের আলমপুর, রতনকান্দি, নাটুয়ারপাড়া, কুমারিয়াবাড়ি, পানাগাড়ি, ও সোনামুখী এলাকায় এই মানুষ বিক্রির হাট এখন জমজমাট। প্রতিদিন সকালে হাট শুরু হয়। ৭টার মধ্যে এই শ্রমজীবী মানুষদের ক্রয় করে নিয়ে যায়। বতর্মানে ধান কাটার মৌসুমে মাঠে পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। কর্মজীবী দিনমুজরদের প্রয়োজন কাজ। এ কারণে কৃষকদের কাছে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে অনেক। তাছাড়াও অন্যান্য কাজেও শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। তাই শ্রমিকের দামও থাকে বেশ চড়া। প্রতিটি শ্রমিকের মূল্য সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার নিচে কোনো শ্রমিক পাওয়া যায় না। এসব হাটে ১৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সে কৃষি শ্রমিক দেখা যায় বেশি।
সরেজমিনে বিভিন্ন হাটে দেখা যায়, কারো হাতে বাঁশের তৈরি বাইং, কারো হাতে ব্যাগ। ব্যাগে হালকা কাপড়-চোপর আর কাঁচি। কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে। হাটের ভেতরে ঢুকতেই কতিপয় শ্রমিক বলেন ‘মামা কামলা লাগবো? কত কইরা দিবেন?
সদর উপজেলার শিয়ালকোল গ্রামের শ্রমিক রেজাউলসহ (৪৬) সাতজনের একটি দল হাটে আসেন। তিনি জানান, সংসারে বিধবা মা, ৩ বোনসহ স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে রয়েছে। তাদের ভরণপোষণের জন্য তাকে কর্মের পথ বেছে নিতে হয়েছে। ১৭ বছরের কিশোর আলামিন জানায়, তার বাড়িতে বিধবা মা। তার জন্য এই কর্মের পথ বেছে নিতে হয়েছে। ছোট বলে কেউ কিনতে চায় না। অল্প দামে বিক্রি হতে হয়।
অন্য ছয়জন ৬০০ টাকা করে বিক্রি হয়েছেন। সে আরো বেশি দামে বিক্রি হওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছে। এক প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘এলাকায় এখন কোনো কাজ নাই। বইসা থাইকা কি করমু? তাই এহনে বোরো ধান ও মাটি কাটার জন্য আইছি। কিছু টাকা জমিয়ে চইলা যামু।’
নাটুয়াপাড়ার চরাঞ্চলের হাসমোত (৪২) জানায়, তার আট বিঘা জমি ছিল। ১৬ বছর আগে যমুনা তা কেড়ে নিয়েছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে এখন অন্যের জায়গায় ভাড়া থাকতে হয়।
৬০ বছরের আজাহার আলী জানান, ছেলেরা যার যার মতো সংসার পেতে নিয়েছে। ভরণপোষণের সময় তাদের নেই। তাই এই বয়সে বাড়ি থেকে বের হয়ে বিক্রির জন্য কান্দাপাড়া হাটে এসেছেন তিনি।
বগুড়ার ধুনুটের বাঁশপাতা গ্রাম থেকে আসা আজাদসহ একাধিক শ্রমিক বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আরো অনেকেই বিক্রি হওয়ার আশায় রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নাটুয়ারপাড়া হাটে দাঁড়িয়ে ও বসে থাকে। বিক্রি না হতে পারলে নাটুয়ারপাড়া স্কুল, মাদরাসা ও কলেজ মাঠে রাতে থাকে। তাছাড়াও জামালপুর থেকেও শ্রমিক আসেন এখানে।’
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন একজন শ্রমিকের দাম সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। তাতে তিনবেলা খাবারসহ এক কামলার দাম পড়ে কমপক্ষে ৮০০ টাকা। আর এখন বাজারে এক মণ ধানের দামও ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা।
নাটুয়ারপাড়া গ্রামের গৃহস্থ ইদ্রিস আলী জানান, কামলার দাম গত বছরের চেয়ে এবার বেশি। তবু কিছু করার নেই। তাই বেশি দাম দিয়েই কামলা কিনতে হচ্ছে। কাজিপুর উপজেলার মাজনাবাড়ি গ্রামের কৃষক হালিম বলেন, ‘আমি নাটুয়ারপাড়া থেকে ৬০০ টাকা দরে পাঁচজন কামলা (শ্রমিক) কিনছি। উত্তরবঙ্গের কামলাদের কাজের মান ভালো। কাজে কোনো ফাঁকি দেয় না। তাদের তিনবেলা খাবার দিতে হয়। আর কাজ করে ভোর থেকে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত।