হাসপাতালে স্যালাইনের জন্য হাহাকার ।
দেশে ডেঙ্গু রোগী বাড়ায় শিরায় দেয়া স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে সব জায়গায়। বিভিন্ন জেলায় শিরায় দেয়া স্যালাইনের সংকট চলছে। সর্দি-জ্বর, ঠাণ্ডা-কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। এতে চাহিদা বেড়েছে এনএস ও ডিএনএস স্যালাইনের। চাহিদার তুলনায় হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে পর্যাপ্ত স্যালাইন না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। হাসপাতালে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চাহিদামতো স্যালাইন দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ভারত থেকে স্যালাইন আমদানি শুরু করেছে সরকার।
গতকাল সরেজমিনে, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সামনে কথা হয় ড্রাগ স্টোরের ম্যানেজার মো. মোস্তফা জানান, স্যালাইনের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। আমরা ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে সরবরাহকারীরা মাত্র ৬ থেকে ১০ টার বেশি দিতে পারছে না। অন্য সময়ে সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা এসে বলতেন কয় ব্যাগ দিবো স্যালাইন। আর এখন তারা দোকানের সামনেও আসে না। দূরে দূরে থাকে। বুঝতে পারছেন, স্যালাইনের কতো চাহিদা। তাহলে রোগীরা কীভাবে সংগ্রহ করছে জানতে চাইলে ফার্মেসির এই প্রতিনিধি জানান, অলিগলির ভেতরে কিছু ছোট ছোট ফার্মেসি আছে। তারা বেশি দামে বিক্রি করে এই স্যালাইন। এখানে কথা হয় নিউ বাংলার ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধির সঙ্গে। তিনি জানান, ১০০ ব্যাগের প্রয়োজন। কিন্তু কোম্পানি দিচ্ছে মাত্র ৬ ব্যাগ। স্যালাইনের মহাসংকট বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। ডেঙ্গু রোগীর কারণে বাজারে স্যালাইনের এই সংকট তৈরি হয়েছে ব লে ফার্মেসির এই বিক্রয় প্রতিনিধি মনে করেন।
ফার্মেসি মালিকদের দাবি, ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন না দেয়ায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, এল সি সহ কাঁচামালের স্বল্পতার কারণে কোম্পানি চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন দিতে পারছে না। যেখানে এক ফার্মেসির প্রয়োজন দুই কেস, সেখানে দেয়া হচ্ছে মাত্র পাঁচ থেকে ১০ ব্যাগ। একমি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পরে স্যালাইন এবং সাপোজিটরের সংকট দেখা দিয়েছে। উৎপাদন করতে না পারায় গত দুই মাস থেকে আমরা চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দিতে পারছি না।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্যালাইন উৎপাদন হয় না। শিরায় দেয়া স্যালাইন উৎপাদন করে ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে স্যালাইন কেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একমাত্র ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড ( ই ডিসিএল)। ইডিসিএল সেসব স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই ছয় কোম্পানি মাসে সাড়ে ৪৬ লাখ ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করে। এর মধ্যে আছে সাধারণ স্যালাইন, গ্লুকোজ মিশ্রিত সাধারণ স্যালাইন ও কলেরার স্যালাইন।
স্যালাইন সংকটের কারণে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু, সার্জারি, ডায়ালাইসিস সহ বিভিন্ন রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো তীব্র স্যালাইন সংকটে ভুগছে। তবে সম্প্রতি দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকট কাটলেও বেসরকারি হাসপাতালে সংকট এখনো কাটেনি। সংকট সমাধানে ৭ লাখ স্যালাইন আমদানির অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এদিকে, সরবরাহ সংকটের কারণে স্যালাইনের দামও বেড়ে গেছে দুই থেকে তিনগুণ। সংকট মেটাতে বাজার মনিটরিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে স্যালাইন আমদানি করা হলে এ সপ্তাহে সংকট কেটে যাবে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
রাজধানীর হাজারীবাগ সেকশনস্থ বিক্রমপুর ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি নাজমুল হাসান মানবজমিনকে বলেন, স্যালাইনের সংকট রয়েছে। বাজারে স্যালাইনের চাহিদা বেশি। তাদের দোকানে এই মুহূর্তে স্যালাইন নেই। সরবরাহকারীরা ঠিকমতো স্যালাইন সরবরাহ করছে না। তিনি জানান, তাদের আশেপাশে ৯০ টাকার স্যালাইন ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ লেলিন চৌধুরী বলেন, এখন চাহিদার তুলনায় স্যালাইনের সংকট অনেক বেশি। আমরা কোম্পানিকে ১০০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা দিলে ১০ বা ২০ ব্যাগ স্যালাইন পাই। আগে আমরা একজন লোক পাঠিয়ে মিডফোর্ড মার্কেট থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্যালাইন নিতে পারতাম। এখন স্যালাইনের খোঁজে তিন চারজনকে মিডফোর্ড মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে পাঠাতে হচ্ছে। স্যালাইনের সর্বোচ্চ দাম ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ছিল, এখন সেই স্যালাইন আমরা ২০০ টাকা প্যাকেট কিনছি। আমাদের ফার্মেসিতে স্যালাইন না থাকায় রোগীদের আমরা লিস্ট ধরিয়ে দিচ্ছি, তারা বিভিন্ন দোকান খুঁজে খুঁজে স্যালাইন কিনছে। সংকটের কারণে দাম বাড়ায় একদিকে রোগীদের চিকিৎসা খরচ যেমন বেড়ে যাচ্ছে, পাশা-পাশি ভোগান্তিও বাড়ছে অনেক। চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ স্যালাইন শুধু ডেঙ্গুই না সিজার, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের সংকটে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাও ব্যাহত হচ্ছে। স্যালাইনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং এর দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে বাজার মনিটরিংয়ের আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ ও ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক (আইন কর্মকর্তা) মো. নুরুল আলম বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। এজন্য দ্রুত ইডিসিএলের (রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি) মাধ্যমে ৭ লাখ স্যালাইন ভারত থেকে আমদানি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আজ-কালের মধ্যে আমদানি করা স্যালাইন আসলে সমস্যা থাকবে না। দেশীয় ৬টি ওষুধ কোম্পানিগুলো তিন শিফটে স্যালাইন উৎপাদন করছে। তারাও সাধারণ স্যালাইন প্রতিদিন ১ লাখ ৩০ হাজার উৎপাদন করে। পাশাপাশি স্যালাইন আমদানির এই অনুমতি দেয়া হলো। তিনি জানান, জেলা প্রশাসকদের গত সপ্তাহে এই বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। কেউ বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে তিনটি ফার্মেসিকে বেশি দামে স্যালাইন বিক্রির দায়ে লাখ টাকার উপরে জরিমানা করা হয়েছে। রাজধানীতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের আটটি টিম এ বিষয়ে বাজারে কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।