কয়েক বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন কুমিল্লার বেগুন চাষিরা। মানে ভালো, দেখতে সুন্দর বেগুন উৎপাদন করেও ন্যায্য দামের অর্ধেকও না পেয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ এখানকার বেগুন চাষিদের কপালে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে বেগুন বিক্রি করতে হচ্ছে এ জেলার বেগুন চাষিদের। দুষ্টচক্রের আড়ৎদার আর অসাদু পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণেই ভোক্তা পর্যায়ে ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেগুন বিক্রি হলেও চাষিরা দাম পাচ্ছেন মাত্র ২ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫ টাকা পর্যন্ত। ফলে উৎপাদন ব্যয়, নিজের পরিশ্রম আর উত্তোলনের পারিশ্রমিক কোনোদিকেই পুষিয়ে উঠতে না পারছেন না তারা।
জেলার সবচেয়ে বেশি বেগুন উৎপাদন হয় বুড়িচং, বরুড়া, দেবিদ্বার এবং চান্দিনা উপজেলায়। এসব উপজেলার চাষিদের মুখে শোনা গেল একই আক্ষেপের কথা। কেউ কেউ দাম না পেয়ে জমিতে ফেলে রেখেই নষ্ট করছেন বেগুন।
বুড়িচং উপজেলার মিথলমা এলাকার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, আমার জন্মের পরে এতো কম দাম পাইনি। কিছুদিন আগে নিমসার বাজারে বেগুন নিয়ে গেছি ১০৭ কেজি। ৭ কেজি বেপারি নিয়ে গেছে ফাও ফাও। আর দাম দিয়েছে ১০০ কেজির। ৫ টাকা কেজি দরে দাম দিল ৫০০ টাকা। এর মধ্যে গাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে ৩০০ টাকা, বাজারের খাজনা ১৫০ টাকা। রাত ১০টায় বাজারে গিয়ে ভোর চারটার দিকে বেগুনগুলো বিক্রি করেছি। রোজার দিন বাজারেই সেহরি খেতে হয়েছে। সেখানে আরও ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা খরচ। এই ১০৭ কেজি মাল বিক্রি করে আমার লাভ হলো না লস হলো?
তিনি বলেন, আমি ১৮ শতক জমিতে বেগুন চাষ করেছি। খবরে শুনি বেগুনের কেজি ৫০ টাকা, ৬০ টাকা, ৭০ টাকা, কিন্তু আমরা ৫ টাকাও বিক্রি করতে পারি না। আজকেও আমার জেঠাতো ভাই দুই টাকা কেজি বিক্রি করেছে। সে বাজারে ফেলে দিয়ে এসে গেছে। আমি যে বাজারে নিচ্ছি, বাজারে ১ টাকাও প্রফিট আসে না। উল্টো ভর্তুকি দিতে হয়।
অনেক কৃষক বিক্রি করতে না পেরে বাজারে ফেলে দিয়ে চলে আসে। বেগুন উত্তোলনের সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু দামের কথা ভেবে অনেকেই উত্তোলন করছে না। ক্ষেতে বেগুনের রং নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কী লাভটা হয়? এই যে রমজান মাস চলছে, সামনে ঈদ। বাচ্চাদের সবকিছু লাগবে। আমরা কৃষক। কৃষি ফসল উৎপাদন করেই সংসার চালাই। সবার ভরণপোষণ আর লেখাপড়ার খরচ চালাই। এভাবে যদি আমাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাই তবে আমরা বাঁচব কীভাবে?
সারের দাম অনেক বেশি। কীটনাশকেরও দাম বেশি। আগে সার ছিল ২০ টাকা কেজি। এখন ৩০-৩৫ টাকা। কৃষকদের এখন যা অবস্থা মরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ১৮ শতক জমিতে আমার ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ১০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারি কি না সন্দেহ।
সায়েদ নামের আরও এক কৃষক বলেন, জীবনের মরা মরেছি ভাই। বেগুন ক্ষেতে পড়ে পচে যাচ্ছে, বিক্রি করতেও পারছি না। আমার ২ লাখ টাকার ওপরে খরচ গেছে। এই পর্যন্ত বিক্রি করেছি মাত্র ২০ হাজার টাকা। ওষুধের টাকাও হয় না। দৈনিক ওষুধ দিলে লাগে ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমার দ্বারা আর সম্ভব না। আর কখনও ফসল উৎপাদন করব না, শেষ।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ূন কবির মাসউদ বলেন, দেশের সকল মানুষ তাকিয়ে থাকে ফসল উৎপাদন করা কৃষকদের দিকে। অথচ সেই কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। পাইকারদের সিন্ডিকেটের কারণেই কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে আর ভোক্তাদের পকেট কাটা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভূমিকা রাখলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পেতে পারেন।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। কৃষকদেরকে ন্যায্য দাম না দিলে কৃষকরা ফসল উৎপাদন থেকে বিমুখ হয়ে যাবে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে পাইকার, আড়ৎদার সবাইকে সংবেদনশীল হতে হবে। কৃষক যদি কৃষিপণ্য উৎপাদন না করেন তাহলে আড়ৎদার আর পাইকাররা কার সাথে, কী পণ্য দিয়ে ব্যবসা করবেন?