বিদেশি ঋণের বিশাল বোঝা বাংলাদেশের ঘাড়ে। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ১৪ বছরে ঋণ বেড়েছে ২৮২ শতাংশ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়ায় ১০১ দশমিক ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার। মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ার পর বাইরের যে পরিমাণ ঋণ পাওয়া যাচ্ছে তা পরিশোধের চেয়ে কম।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট-২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৫৭২ বিলিয়ন ডলার। ১৪ বছরের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ২৮২ শতাংশ বা ৭৪ দশমিক ৮৭৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০১ দশমিক ৪৪৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে সবেচেয়ে বেশি ২৭৪ শতাংশ। ২০১০ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ২২ দশমিক ২২২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৮৩ দশমিক ২৮৪ বিলিয়ন ডলারে। বেড়েছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধও। ২০১০ সালে ২০৩ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করা হলেও ২০২৩ সাল শেষে সুদ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭২১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। ২০১০ সালে আইএমএফের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৪০২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৩২ বিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ বেড়েছে। ২০১০ সালে ২ দশমিব ৯৪৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ থাকলেও ২০২৩ সাল শেষে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ২৩১ বিলিয়ন ডলারে। ঋণ গ্রহণ বেড়েছে ৩৮২ শতাংশ। একইভাবে ২০১০ সালে ২০৩ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করা হলেও ২০২৩ সাল শেষে সুদ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭২১ বিলিয়ন ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৭৪৭ শতাংশ।
সার্বিকভাবে বিদেশি ঋণ বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে ৬ মাসে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ কমেছে প্রায় ২ শতাংশ। চলতি বছরের জুন শেষে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও ৯ মাসে (চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ কমেছে ৭০৬ মিলিয়ন ডলার। পদ্মা রেল সংযোগ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলের মতো কয়েকটি মেগা প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু হওয়ায় যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে পরিশোধ করতে হয়েছে তার চেয়ে ২৮ কোটি ডলার বেশি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সুদ-আসল মিলে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ঋণ পরিশোধ বাড়লেও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড় কমেছে। গত প্রান্তিকে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্থ ছাড় কমেছে ৪৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। এ সময় অর্থ ছাড় হয়েছে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ১২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার। নতুন করে ঋণ প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯৯ শতাংশ। এই সময়ে মাত্র ২ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৮৮ কোটি ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ বাড়লেও পরিশোধ করার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। তাহলে এ ঋণ কোনো শঙ্কা তৈরি করবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, মেগা প্রকল্পগুলো করতে গিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দুঃখজনক হলো এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার ছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ঋণের গ্যারান্টি দেওয়া হয়, এগুলোর অনেক কিন্তু সরকারি ব্যাংকই দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠানও আছে কিছু। এখন এই গ্যারান্টির ঋণগুলোও যদি তারা ফেরত দিতে না পারে, তাহলে এটা দুশ্চিন্তার বিষয়।