বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ ঠিক কীভাবে ও কখন প্রচলিত হয়েছিল, তা এখনও একেবারে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। তবে নানান পরোক্ষ প্রমাণে এবং গবেষণায় মনে করা হয়, সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন।
এক সময় নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। কৃষিকাজ ঋতুনির্ভর হওয়ায় এ উৎসবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। তাই কৃষক সমাজের সঙ্গে বাংলা সন এবং নববর্ষের একটি আত্মিক সম্পর্ক গ্রথিত হয়ে আছে ঐতিহাসিকভাবে। কেননা, বাংলা সনের উৎপত্তি হয় কৃষিকে উপলক্ষ করেই।
অনেক গবেষকের মতে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনাও হয় আকবরের সময় হতে। বাংলা বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখ-ই-এলাহী বা ফসলি সন নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ অথবা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। আকবরের রাজত্বের ঊনত্রিশতম বর্ষ, অর্থাৎ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তিত হলেও তা গণনা করা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। কারণ, এদিন আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আকবরের বিজয়কে মহিমান্বিত করে রাখার লক্ষ্যে সিংহাসনে আরোহণের দিন থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হলেও কৃষি কাজের সুবিধার্থে এবং কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ে সুবিধার জন্যই মূলত সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন।
হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। বাংলা সন প্রবর্তনের আগে মুঘল সম্রাটরা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে হিজরি বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন। বাংলা সন প্রচলিত হওয়ার পর থেকে মুঘলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পয়লা বৈশাখ পালন করতেন। কৃষকরাও নববর্ষ পালন করতেন যথেষ্ট আড়ম্বর। সে সময়ে বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতেন। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীদের তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
বাংলা সনের জন্মলগ্ন থেকে নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ এবং কৃষকদের কাছে দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় খাজনার দায় পরিশোধের বিষয়টি না থাকলেও সামর্থ্য মতো সারা বছরের ধার-দেনা পরিশোধ করে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু করার অভিপ্রায় সব কৃষকের মনেই থাকে। তেমনি এক দায়মুক্ত মানসিক প্রশান্তিতে কৃষকরা নববর্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, কৃষি ও ব্যবহার্যসামগ্রী ধোয়ামোছা করে এবং সকালে স্নানাদি সেরে পুতপবিত্র হয়। এ দিনটিতে ভালো খাওয়া, থাকা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করেন। এদিন ঘরে ঘরে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। মিষ্টি, পিঠা পায়েসসহ নানারকম লোকজ খাবার তৈরি করারও ধুম পড়ে যায়। একে অন্যের সাথে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় চলে।
এ ছাড়াও নববর্ষকে আরো উৎসবমুখী করে তোলে বৈশাখী মেলা। সার্বজনীন লোকজ এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন ও উৎসবমুখর আমেজে উদযাপিত হয় দেশের বিভিন্ন গ্রাম-পল্লীতে। অবশ্য শহরাঞ্চলে এ মেলা বসে নগর সংস্কৃতির আদলে, ভিন্ন আমেজে।
তবে দেশের তিন পার্বত্য জেলা— রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে নববর্ষ উদযাপিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন। এ তিন দিন মিলেই বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয় এ তিন জেলায়। উপজাতিদের কাছে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রতিবছর আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত এ উৎসবকে ত্রিপুরাতে বৈসুক, মারমার জনগণ সাংগ্রাই এবং চাকমা জনসাধারণ বিজু নামে আখ্যা দিলেও ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবে সমগ্র পার্বত্য এলাকায় ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। বেসুক, সাংগ্রাই ও বিজু— এই নামগুলোর আদ্যাক্ষর নিয়েই ‘বৈসাবি’ শব্দের উৎপত্তি। বছরের শেষ দুদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন, এ তিনদিন মিলেই মূলত বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ পালিত হয়। পুরনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে জুমিয়া কৃষকসহ আপামর পাহাড়ি সম্প্রদায় সেই আদিকাল থেকে তিন দিনব্যাপী এ বর্ষবরণ উৎসব পালন করে আসছেন।