নানা কারণে ধান বা অন্য ফসলের তুলনায় আমে মুনাফা বেশি হওয়ায় বাগানমালিকরা এখন আম চাষে ঝুঁকছেন। মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে মোটাদাগে আম উৎপাদন হয়। এ ছাড়া নতুন এলাকা আম উৎপাদনের আওতায় আসছে। উৎপাদনের সঙ্গে বড় হচ্ছে আমের বাজার।
দেশে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাজার রয়েছে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যদিও গত বছরের তুলনায় এ বছর আমের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারপরও যথাযথ দাম এবং বিদেশে রপ্তানিতে বাজার বাড়তে পারে বলে জানান তারা। বিদেশে আম রপ্তানির পরিমাণ প্রতি অর্থবছর প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন করে বাড়ছে। এ অর্থবছরে আমের রপ্তানি সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতিসহ সাতক্ষীরা, রংপুরের হাঁড়িভাঙা ও নওগাঁর আম। বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদিত আমের জাতের সংখ্যাও বেড়েছে। আগে দেশের মানুষ ফজলি, ল্যাংড়া, আশ্বিনিসহ চার থেকে পাঁচ জাতের আম চিনত। এখন ক্ষীরশাপাতি, হিমসাগর, আম্রপালি, গোপালভোগ, হাঁড়িভাঙা, লক্ষ্মণভোগসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম চাষ হচ্ছে। চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর আমের ফলন কম হয়েছে। মুকুল আসার সময়টায় এবার ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ ছিল।
কৃষিবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আমে মুকুল আসার সময়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রির মধ্যে থাকাই শ্রেয়। এর বেশি বা কম হলে আমের মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চলতি বছর শীত মৌসুমে তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রিরও নিচে নেমে মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে সময় ঘন ঘন শৈত্যপ্রবাহ যেমন আমের মুকুল তৈরি ও গুটিতে বাধাগ্রস্ত করেছে। তেমনি এপ্রিলজুড়ে অধিক তাপমাত্রার কারণে আমের গুটি থেকে ছোট আম ঝরে গেছে।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র (সাবেক আম গবেষণা কেন্দ্র), চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুখলেসুর রহমান বলেন, দেশে গড় আম উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। যদিও পরিসংখ্যানে বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যের ভিন্নতা রয়েছে।
গত ৫ বছরে ২৩ থেকে ২৫ লাখ টনের মধ্যে আমের উৎপাদন ওঠানামা করছে। গত বছর ২৭ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। এবার অনেক কম হবে। তবে কতটুকু হবে তা বলা যাচ্ছে না। মুকুল দেরিতে আসছে। এর পর তীব্র তাপমাত্রার কারণে মুকুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শীত দীর্ঘ সময় ছিল। এবার বড় গাছে মুকুল আসেনি। যা এসেছে ছোট গাছে এসেছে। যেখানে ছোট গাছ আছে সেখানে উৎপাদন বেশি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশে আমের উৎপাদন ২৭ লাখ টনের মতো। প্রতিবছর প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়। আম উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন, মোড়কীকরণ ও পরিবহন মিলিয়ে এ বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতিবছর এপ্রিলে কাঁচা আম বাজারে আসা থেকে শুরু হয় এ বাণিজ্য। চলে সেপ্টেম্বরে আশ্বিনা আম বিপণন শেষ হওয়া পর্যন্ত। আম পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং উৎপাদন পর্যায় আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার না করায় আমের ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ২৯ টন। রপ্তানি হয় ৩১০ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৮ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৬৮ টন এবং রপ্তানি হয়েছিল ২৮৩ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ টন, রপ্তানি হয়েছিল ৭৯১ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৯৮ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ টন, রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৮ লাখ হেক্টর জমিতে ২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৭ টন, রপ্তানি হয়েছে ৩১০০ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৫ লাখ হেক্টর জমিতে। তবে এ বছর গত অর্থবছরের থেকে উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, এ বছর আমের উৎপাদন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমতে পারে। এই তথ্য সিজন শেষে বলা যাবে। যারা বাণিজ্যিকভাবে আমের উৎপাদন করে তাদের ফলন ভালো হয়েছে। আমের দাম গতবারের চেয়ে এবার বেশি হবে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক হিসেবে খুব একটা পার্থক্য হবে না। পার কেজিতে আমের দাম এবার বাড়বে। তবে আমের উৎপাদন কম হলেও যথাযথ দাম পেলে বাজার গত বছরের মতো ১৪ হাজার কোটি টাকার আশপাশেই থাকবে।