‘এই মুহূর্তে আমরা এক ধ্বংসস্তুপের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। আজ সোমবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া সংবর্ধনায় আপিল বিভাগের আদালত কক্ষে দেয়া বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের শুরুতে সাম্প্রতিক ঘটনায় নিহতদের স্মরণে প্রধান বিচারপতির দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে আহ্বান জানালে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, আইনজীবীসহ উপস্থিত সবাই নীরবতা পালন করেন।
এরপর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা ও গভীর শ্রদ্ধা জানাই গণজাগরণে আত্মদানকারী প্রত্যেক শহীদের স্মৃতির প্রতি। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
ছাত্র-জনতার এই অভুত্থানের সময় অসংখ্য শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের অনেকেই এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমি তাদের সবার দ্রুত নিরাময় ও সুস্থতা কামনা করছি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শিষ্টের লালন ও অন্যায়ের দমন হলো বিচার বিভাগের শাশ্বত দায়িত্ব। বিচারক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যে কেউ অন্যায় বা শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যে কেউ ভালো কাজ করলে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু কোনো ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এর ফলে সংঘটিত গণ–অভ্যুত্থানের কারণ আপনারা সবাই অবগত। এই মুহূর্তে আমরা এক ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাড়িয়ে আছি।
বিগত বছরগুলোতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আমাদের বিচারবোধ, ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। সততার বদলে শঠতা, অধিকারের বদলে বঞ্চনা, বিচারের বদলে নিপীড়ন, আশ্রয়ের বদলে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছে।
অথচ এ রকম সমাজ ও রাষ্ট্র আমরা চাইনি। এই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে।’
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সারা দেশের সব ছাত্র-জনতা–শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি আরও অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের সব স্তরের জনগণকে, যারা শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
আজ থেকে প্রতিটি শ্রেয়, শুভ ও কল্যাণকর কর্মে সবাই বিচার বিভাগকে আপনাদের পাশে পাবেন। আমি সচেতন আছি, আমাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ছাড়াও জেলা জুডিশিয়ারি হলো বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় ও বিস্তৃত ক্ষেত্র।
অধস্তন জুডিশিয়ারিতে কর্মরত বিচারক সহকর্মীরা আমরা সবচেয়ে বড় শক্তি। দেশের সাধারণ মানুষ বিচার বিভাগ বলতে মূলত ডিস্ট্রিক্ট জুডিশিয়ারিকে বোঝেন।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জুডিশিয়াল সার্ভিসে কর্মরত সহকর্মীদের বলছি, আমি আপনাদের পাশে আছি। আপনারা কোনো ধরনের অন্যায়, চাপ ও ভয়ভীতির আশঙ্কা করবেন না। নির্ভয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে বিচারিক কাজ পরিচালনা করুন।
আমরা সবাই জানি, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে ভগ্নদশা থেকে বিচার বিভাগও মুক্ত নয়। কিন্তু ছাত্র–জনতার বিজয়ের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে।
আমরা যেন এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারি, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
প্রধান বিচারপতিকে দেয়া এই সংবর্ধনায় আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বক্তব্য দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবীর মুখে ১০ আগস্ট দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগের পর নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
এরপর ১১ আগস্ট বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
১৯৫৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া সৈয়দ রেফাত আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওয়াদাম কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
তিনি ফ্লেচার স্কুল অফ ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি অফ টাফ্টস ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
সৈয়দ রেফাত আহমেদ ১৯৮৪ সালে জেলা আদালতে, ১৯৮৬ সালে হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হন। ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়ার দুই বছর পর হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হন।
সৈয়দ রেফাত আহমেদ সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা প্রয়াত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং প্রয়াত প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ও একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষা সৈনিক সুফিয়া আহমেদের ছেলে।