আদমদীঘির ঐতিহ্যময় তাঁতশিল্পের গ্রাম শাওইল বাজার।
আদমদীঘি প্রিতিনিধি ঃ
বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার তাঁত শিল্প দেশের তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখছে। এই শিল্প
শীতের সময়ে সরগরম হয়ে ওঠে ওই এলাকার শীতবস্ত চাদর ও কম্বল তৈরীর কারখানাগুলো । এই তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র
করে শত শত যুবক এখন ব্যস্ত সময় পার করছে। তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে শত শত পারবার হয়েছে স্বাবলম্বি। এই
শিল্পের মাধ্যমে এই অঞ্চলের যুবকদের বেকারত্বের অবসান হয়েছে।
আদমদীঘি উপজেলা সদর হতে মাত্র ৬ কিলোমিটার উত্তর- পশ্চিমে অবস্থিত শাওইল বাজার । এই বাজারে প্রতি
বুধ ও রোববার হাট বসে। প্রাচীন কাল থেকেই এই গ্রামে তাঁতী শ্রেনীর মানুষের বসবাস। পর্যায়ক্রমে
এই হাটের প্রাচীনতা আর জনপ্রিয়তার জন্য এবং চাদর কম্বল এই হাটে বেচাকেনা হয় বলে মানুষ এই
হাটের নাম দিয়েছে ‘চাদর কম্বল হাটের গ্রাম।’ ভোর ৪টা থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলে সকাল ১০ টা
পযর্ন্ত। এই হাটকে ঘিরে ৭৫টি গ্রামে গড়ে উঠেছে তাঁত শিল্প্ধসঢ়;।
তাঁতের খটখট শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে শাওইল সহ আশে পাশের গ্রামের মানুষের স্বপ্ন। কারো
রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউবা শ্রম দিচ্ছে অন্যের তাঁত্ধেসঢ়;। কেউ সুতা ছড়াচ্ছে আবার কেউবা
চড়কা নিয়ে বসে সুতা ববিন করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ২ থেকে ১০টা পযর্ন্ত তাঁত রয়েছে।
কোনটি চাকাওয়ালা আবার কোনটি একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরী। শাওইল গ্রাম ছাড়া
দত্তবাড়িয়া, মঙ্গলপুর, ধামাইল, ঘোড়াদহ, মুরাদপুর. ছাতিয়ানগ্রাম, লইকুল, ছাতনীসহ আশেপাশের ৭৫ টি
গ্রামের চিত্র একই রকম।
শাওইল গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা তাঁত শিল্পকে ঘিরে। শাওইল গ্রামের পাশের ৭৫ টি গ্রামের
প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার আছে আর এ শিল্পকে ঘিরে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষের
বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলে। কেউ বংশ পরস্পরায় আবার কেউবা নতুন করে। শীত শুরুর আগেই শাওইল সহ
আশে পাশের তাঁতিরা শুরু করে কম্বল তৈরীর কাজ। এ ছাড়া বছর জুড়েই চলে তাঁতে বোনা ও সুতাই তৈরী বড়
চাদড়, বড় কম্বল, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লেডিস চাদর, সিঙ্গেল কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালা সহ
নানা ধরনের শীত বস্ত্র ও পোষাক। শাওইলের হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন রযেছে ১০০০ থেকে
১৫০০ টি দোকান।
খুবই উন্নত মানের চাদর হওয়ায় এই চাদরের চাহিদ সারা দেশে এবং দেশের বাইরে এখন এগুলি রপ্তানি হচ্ছে।
আবার বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাদর
সহ আনুসাঙ্গিক পন্য। কোনো ধরনের প্রচার, সরকারি-বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে
বিশাল এক কর্মক্ষেত্র। শাওইলের প্রায় প্রতিটি বাড়ির মহিলারা যাঁরা তাঁতি তারা তাঁদের বাড়িতে
সোয়েটার থেকে সুতা খুলে রং ও চড়কায় দিয়ে ববিন করার কাজ করে। আর পুরুষ সদস্যরা চড়কা দিয়ে কম্বল
ও চাদর বুননের পর তা বাজারজাত করার কাজ করে। এ্ধসঢ়;কটি কম্বল বুনতে প্রায় দুই থেকে তিন ঘন্টা সময়
লাগে। আর সুতা লাগে ১২ ববিন। কম্বলের দামের প্রকারভেদ আছে। যেমন -কম্বলের দাম ১০০ থেকে ৬০০ টাকা
এবং চাদরের দাম ২০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
চাদর তৈরির পাশাপিিশ এখানে গড়ে উঠেছে শীত বস্ত তৈরির মেশিন, সুতা, রং তাঁতের চড়কা, লাটাইয়ের
ব্যবসা ইত্যাদি। বাজারের আশে পাশে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক দোকান। দোকান গুলিতে নিয়োজিত
আছে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। শাওইল বাজারের এ ব্যবসার প্রধান সমস্যা অউন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা।
আদমদীঘি থেকে এই বাজারের দুরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। এই দুরত্বের মাঝখানে মোড় রয়েছে ৩৭টি
আর পুরো রাস্তা জুড়ে রযেছে খানা- খন্দক। এ কারনে ট্রাকে মালামাল বহনে অসুবিধা হয় । আর শাওইল
বাজারে নেই কোন ব্যাংক ব্যবস্থা। এই হাটে এক ব্যবসায়ী মোঃ গুলবর হোসেন জানান, ‘বছরের পিক
সিজিনের চার মাস হাটের ছোট বড় প্রায় ১০০০ থেকে ১৫০০ সব দোকান মিলে প্রতিদিন ৩ থেকে
সাড়ে ৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়। আর অফ সিজিনে আট মাসে গড়ে প্রতিদিন অন্তত দেড় কোটি
টাকার লেনদেন হয়। এই হিসাবে গত বছরে এই হাটে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।’
তাঁত শিল্পীদের পর্যাপ্ত মূলধনের জোগান, সুষ্ঠভাবে বাজারজাত করনের সুযোগ এবং ঠিকমতো
কাঁচামাল সরবরাহ করলে এখনও আগের মতো জনপ্রিয় আর গৌরবময় করে গড়ে তোলা যায় এদেশের
তাঁতশিল্পকে। প্রয়োজন কেবল সরকারি-বেসরকারী উদ্যোগ। আর তা পেলে বেচে যাবেন তাঁত নির্ভর
মানুষেরা, যাঁরা নিরন্তর স্বপ্ন বুনে চলেছেন কেবল মানুষের জন্য।